প্রতিদিনের খাবারে আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা কিছু খাচ্ছি যেমন, ডাল,ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ফল সবকিছুতেই ভেজাল মিশে আছে যা হচ্ছে বিষ। আমরা প্রতিদিন অজান্তেই গ্রহণ করছি এবং মৃত্যু-ডেকে আনছি-যা হচ্ছে রাসায়নিক। যে দুধ শিশুদের সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য হওয়ার কথা, সেটিতেও মেশানো হয় ডিটারজেন্ট ও ইউরিয়া। বাজারের ফল পাকানো হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইডে, মাছকে টাটকা রাখতে ব্যবহার হয় ফরমালিন, আর শাক-সবজিতে থাকে অতিমাত্রায় কীটনাশক ও টেক্সটাইল ডাই।
কিছুদিন আগে একটি গবেষনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া অনেক সবজিতেই কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ (pesticide residue) রয়েছে সহনীয় মাতার অনেক গুণ বেশি। একটি নমুনায় পাওয়া গেছে ২০০০ পিপিনি (ppb), সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত সীমা মাত্র ১০ পিপিনি। অর্থাৎ, আমরা প্রতিদিন যে সর্বতি খাচ্ছি, তাতে অনুমোদিত সীমার চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ বেশি বিষ গ্রহণ করছি। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এট রাসায়নিক পদার্থগুলোর কারণে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মাটি,লিভার , কিডনি ও মস্তিষ্ক। একসময় এই ক্ষতি ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দেয় যুবক বয়সেই স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক । এক সময় মনে করা হতো, এসব সমস্যা কেবল বয়সি মানুষদের কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অফিসপাড়ার তরুণ যুবক, এমনকি কিশোর বয়সিরাও হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে। ডাক্তারদের মতে, খাবারের বিষাক্ত উপাদানগুলো শুধু শারীরিক অঙ্গ পতঙ্গ-ই নষ্ট করে না, এটি এ না, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। বিষের বিষাক্ত রাসায়নিক মস্তিদের নিউরোট্রান্সমিটার ব্যাহত করে উদ্বেগ, বিষন্নতা, এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলাফল অসুস্থ দেহ ও বিপর্যন্ত মন নিয়ে বড় হচ্ছে এক পুরো প্রজন্ম
অথচ এই সমস্যার কোনো কার্যকর সমাধান এখনো দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে কিছু খাদ্য , মাছ,মাংস দোকানে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়, তারপর আবার সব আগের মতো চলতে থাকে। দেশের কোটি কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা একটি 'হিডিয় ইভেন্ট' এ সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এই ব্যর্থতার দায় শুধু সরকারের নয়, পুরো সমাজের। আমরা এমন এক সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে সততা নয়, প্রতারণা সফলভার মাপকাঠি। ব্যবসায়ী জানে সে ভেজাল মেশাচ্ছে, তবুও করে, কারণ জানে কেউ তাকে জবাবদিহি করতে আসবে না। ভোক্তাও জানে খাবারে বিষ আছে, তারপরও চুপ থাকে , কারণ বিকল্প নেই। প্রশাসনও জানে, কোথায় ভেজাল হচ্ছে, কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, দুধ, আর স্বার্থের জাল জড়িয়ে আছে; এক কথায় এ এক সম্মিলিত নীরবতার সংস্কৃতি। এই নীরবতা শুধু অপরাধীদের উৎসাহিত করে না, এটি ধীরে ধীরে জাতির নৈতিক ভিত্তিও ধ্বংস করে দিচ্ছে ।যখন একটি জাতি বুঝে নেয় টিকে থাকতে হলে প্রতারণা করতে হয়, তখন সেই জাতি আর সভ্য সমাজ বলে পরিচিত হতে পারে না। আজকের তরুণরা এই ভাড়া সমাজেই বড় হচ্ছে যেখানে ভেজাল শুধু খাবারে নয়, নীতিতেও, চিন্তাতেও , সম্পর্কেও। আমরা এমন
এক প্রতিযোগিতায় নেমেছি, যেখানে সবাই অন্যকে পেছনে ফেলার জন্য দৌড়াচ্ছি। যে দৌড়ে সততা, মানবতা, আর দায়িত্ববোধ হারিয়ে গেছে। আমরা চাই দ্রুত ধনী হতে, বড় হতে, প্রভাবশালী হতে। কিন্তু ভুলে যাই, এই দ্রুততার সংস্কৃতি আমাদের মনুষ্যত্বকে গ্রাস করছে।
যখন তরুণ প্রজণ্য এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তখন জরুরি ছিল গভীর গবেষণা ও জনস্বাস্থ্যভিত্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ঠিক উল্টো ।আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খাদ্যনিরাপত্তা বা টক্সিকোলজি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই। সরকারি পর্যায়েও নেই শক্তিশালী কোনো খাদ্য পরীক্ষা ও মনিটরিং ব্যবস্থা। সামান্য পরিদর্শন, ল্যাব থাকলেও সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত জনবল ও নিরপেক্ষতার অভাব প্রকট।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে তার তরুণ প্রজন্মের সুদ্ধতা ও শক্তিমত্তার ওপর। অথচ আমরা যেন নিজেদের হাতেই আগামী প্রজন্মকে ধীরে ধীরে হত্যা করছি- ফরমালিনে, কানাইডে, নকল প্যাকেটজাত খাবারে, আর বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে।এই অবস্থায়ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নীরবতা এবং সমাজের উদাসীনতা আমাদের মানবিকতার বার্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সময় এসেছে এই নীরবতা ভাঙার। আমরা যদি চাই, পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থভাবে বেড়ে উঠুক,তাহলে তিনটি ক্ষেত্রে জরুরি পনক্ষেপ নিতে হবে।
১. জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ: ফরমালিন, কার্বাইড, কীটনাশক ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার ও বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোরতম আইন প্রয়োগ । শুধু অইন করলেই চলবে না, তার বাস্তবগুণ নিশ্চিত করা । আদালতের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাহলে ভেজাল রোধ হবে। ভেজাল কে 'অপরাধ' নয়, 'রাষ্ট্রদ্রোহ'-এর পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিত, কারণ এটি জাতিকে ধ্বংস করছে।
২. সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণায় বড় পরিসরে অর্থায়ন জরুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক টেস্ট ল্যাব স্থাপন করে নিয়মিতভাবে খাদ্যের মান যাচাই করা । স্থানীয় প্রশাসনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিটি জেলার বাজার মনিটরিং জোরদার করা।
৩. নৈতিকতা ও নাগরিক সচেতনতা। আইনের প্রয়োগ যতই কঠোর হোক, নৈতিকতার জাগরণ ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ব্যবসায়ী, উৎপাদক, পরিবেশক, এমনকি ভেজালের মধ্যেও নৈতিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রমে 'খাদ্য নিরাপত্তা ও নৈতিক ব্যবসা' বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরে দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি না হলে আমরা বারবার একই জায়গায় ফিরে যাব। আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন মৃত্যুর ধরন বদলে যাচ্ছে। এক সময় সন্তান পিতা মাতার জন্য শোক করত। এখন সন্তানকে হারিয়ে পিতা মাতা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি একেকটি পরিবার, একেকটি স্বপ্নের মৃত্যু। এই অকাল মৃত্যুজলে আমাদের শুধু কাঁদাচ্ছে না, আমাদের চেতনাকের নাড়া দিচ্ছে। আমরা কি এই প্রজন্মকে ধ্বংস হতে দেব , আমরা কি চুপচাপ বসে থাকব? না, সময় এসেছে জেগে ওঠার, নড়েচড়ে বসার। ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুধু সরকারের নয় এটি প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। দোকানদার, কৃষক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক সবাইকে যুক্ত হতে হবে এই সংগ্রামে। তরুণদের অকাল মৃত্যু কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের ক্ষতি। সুস্থ তরুণ ই একটি জাতির শক্তি। অসুস্থ তরুন মানে দুর্বল রাষ্ট্র। তাই এখনই সময়, পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। আর কোনো যুবক যেন ভেজালের বিষে অকালে ঝরে না যায়। এই নীরব মহামারি আর চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও সংগঠক, কুমিল্লা।।
উপদেষ্টাঃ আলহাজ সিরাজ আহমেদ | প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রফিকুল ইসলাম রনি | প্রধান সম্পাদকঃ ইব্রাহিম রুবেল | বার্তা সম্পাদকঃ আব্দুল বারী |
যোগাযোগঃ
৬/সি, আনেমা ভিস্তা (৭ম ফ্লোর), ৩০ তোপখানা রোড, ঢাকা ১০০০।
মোবাইলঃ ০১৮২৪২৪১০২৩, ০১৭১৯২৬৪০৪৫