
আরিফ আহমেদ মুন্না।। বরিশালের বাবুগঞ্জে উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার ভুল চিকিৎসায় একটি গর্ভবতী গাভী মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসক শাহ আলমের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ ইউএনও এবং ইউএলও'র কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন গাভীর মালিক। তবে সেই অভিযোগের সত্যতা পায়নি গঠিত তদন্ত কমিটি। ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগের ভাষ্যমতে রাতে ১১টি ইনজেকশন প্রয়োগের সাথেসাথেই গাভী মৃত্যুর অভিযোগ করা হলেও এটি মারা যায় পরদিন সন্ধ্যায় বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি।
এদিকে রাতেই গাভী মৃত্যুর মিথ্যা দাবি তুলে চিকিৎসককে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করায় সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। গাভীর মালিক কৃষক ছবুর হাওলাদার রাজনীতি না করলেও তার সাথে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা পশু হাসপাতালে চড়াও হওয়ায় ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। অপরদিকে অভিযোগটি সাজানো এবং পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক শাহ আলম।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাবুগঞ্জ উপজেলার উত্তর দেহেরগতি গ্রামের কৃষক ছবুর হাওলাদারের ৯ মাস ১৫ দিনের অন্তঃসত্ত্বা একটি গাভী কিছুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়। এরপরে তিনি এসিআই ওষুধ কোম্পানির ভেটেরিনারি ডিভিশনের বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজ হোসেনের পরামর্শে গ্যাস নিরাময়ের ওষুধ খাওয়ানোর পরে গাভীটি একেবারেই খাওয়া ছেড়ে দেয়। এরপরে গত ৯ নভেম্বর গাভীর অবস্থা আরো অবনতি হয়ে এটি মাটিতে শুয়ে পড়লে রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলমকে ফোন করে বাড়িতে ডাকেন কৃষক ছবুর হাওলাদার। এসময় শাহ আলম ওই গর্ভবতী গাভীর অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তবে ছবুর হাওলাদার তাকে বাড়িতেই চিকিৎসা প্রদানের অনুরোধ করলে শাহ আলম গাভীকে স্যালাইন পুশ করাসহ কয়েকটি ইনজেকশন দেন এবং পরদিন সকালে গাভীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। এদিকে শাহ আলম চিকিৎসা দিয়ে ফেরার ২ ঘন্টা পরে রাত দেড়টার দিকে ছবুর হাওলাদার ফোন করে তাকে গাভীর মৃত্যু সংবাদ দেন এবং কথার একপর্যায়ে তাকে আশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
এদিকে রাতে গাভী মৃত্যুর অভিযোগ করলেও পরদিন সকালে ছবুর হাওলাদার আরেক ভেটেরিনারি পল্লী চিকিৎসক (কোয়াক ডাক্তার) দুলাল হোসেনকে বাড়িতে ডেকে পাঠান। তবে দুলাল হোসেন গাভীটি সংজ্ঞাহীন এবং মুমূর্ষু দেখে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে ফিরে যান। সন্ধায় গাভীটির মৃত্যু হলে পরদিন ১১ নভেম্বর স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে উপজেলা পশু হাসপাতালে চড়াও হন কৃষক ছবুর হাওলাদার। এসময় তিনি শাহ আলমের ভুল চিকিৎসায় তার গাভী মৃত্যুর অভিযোগ তুলে হাসপাতালে বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ওই লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে ইউএনওর নির্দেশে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ প্রদীপ কুমার সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্ত কমিটি প্রধান করা হয় উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ মাহফুজ আলমকে। তিনি তদন্ত কার্যক্রমে স্বচ্ছতার স্বার্থে সাংবাদিকদের মনোনীত প্রতিনিধি সাথে নিয়ে শুক্রবার দিনভর ঘটনাস্থলে তদন্ত করেন। এসময় অভিযোগকারী ছাড়াও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরপেক্ষ বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। রোববার তিনি সংশ্লিষ্ট দুই ভেটেরিনারি পল্লী চিকিৎসকের (কোয়াক ডাক্তার) জবানবন্দী গ্রহণ করেছেন।
গাভীর মালিক কৃষক ছবুর হাওলাদারের দাবি, উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম তার গর্ভবতী গাভীকে ইনজেকশন দেওয়ার আগ পর্যন্ত সেটা দাঁড়িয়ে ছিল। ইনজেকশন দেওয়ার সাথেসাথেই গাভীটি শুয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। রাতে গাভী মৃত্যুর অভিযোগ তুলে চিকিৎসককে গালাগালি এবং পরদিন সন্ধ্যায় সেই গাভীর মৃত্যু বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, 'কখন মৃত্যু হয়েছে জানি না তবে আমার দাঁড়ানো গাভীটা শাহ আলমের ভুল চিকিৎসার জন্যেই মারা গেছে। তাই আমি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাই।'
উত্তর দেহেরগতি গ্রামের ছবুর হাওলাদারের প্রতিবেশি কৃষক ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জাকির হোসেন বলেন, 'ছবুর হাওলাদারের গর্ভবতী গাভীটা আগেই অসুস্থ ছিল। গাভীটা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে দুর্বল হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। শাহ আলম ডাক্তার আসার আগে স্থানীয় মিরাজ ডাক্তার কয়েকদিন গাভীটার চিকিৎসা করেছে। তবে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গাভীটা মাটিতে শুয়ে পড়ার পরে শাহ আলম ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়। তিনি দেখেই বলেছিলেন গাভীটা বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। তবুও ছবুরের অনুরোধে তাকে স্যালাইন আর কয়েকটা ইনজেকশন দিতে দেখেছি। পরদিন সকালেও গাভীটা বেঁচেছিল। সকালে দুলাল ডাক্তারকে ডেকে এনে গাভীর পেটের বাচ্চাটা ডেলিভারি করার চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনিও বলেছিলেন এই গাভী কিছুতেই বাঁচবে না। শেষ পর্যন্ত এটা ১০ তারিখ সন্ধ্যায় মারা যায়। আমরা গরুটিকে মাটিচাপা দিয়ে দাফন করেছি।'
কৃষক জাকির হোসেনের বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করে স্থানীয় ভেটেরিনারি পল্লী চিকিৎসক (কোয়াক ডাক্তার) দুলাল হোসেন বলেন, 'আমি ১০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গিয়ে দেখতে পাই গাভীটি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে এবং এর গায়ের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তারপরে জানতে পারি গতরাতে এই গাভীর চিকিৎসা দিয়েছেন উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম স্যার। তিনি আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার হওয়ায় আমি আর কোনো চিকিৎসা দেইনি। তাছাড়া এই অন্তিম মুহূর্তে চিকিৎসা দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। গাভীর মালিক বলেছিলেন আমি যেন ওষুধ দিয়ে তাৎক্ষণিক পেটের বাচ্চাটা ডেলিভারি করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু সেটাও সম্ভব ছিল না। পরে আমি তাকে বানারীপাড়া উপজেলার সবুজ ডাক্তারের নম্বর দিয়ে আসি।'
আরেক কোয়াক ডাক্তার একই গ্রামের এসিআই ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ভেটেরিনারি ডিভিশনের বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজ হোসাইন মুঠোফোনে বলেন, 'আমি ছবুর হাওলাদারের গর্ভবতী গাভীকে গত ৪ নভেম্বর প্রথম চিকিৎসা করি। গাভীটি তখন খাওয়া-দাওয়া অনেকটা কমিয়ে দেওয়ায় আমি তার পেটের গ্যাস কমানোসহ রুচি বৃদ্ধির ওষুধ দেই। তবে এতে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ছবুর হাওলাদার গত ৯ নভেম্বর আবার আমাকে ফোন করে বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু আমি অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় থাকায় সরকারি হাসপাতালের উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম স্যারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেই এবং আমি নিজেও স্যারকে ফোন করে ওই বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করি। একজন ডাক্তার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন তার রোগী বাঁচাতে। উনারা হয়তো ভুল বুঝে এই অভিযোগ দিয়েছেন।'
অভিযোগ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, 'গত ৯ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় একটি গর্ভবতী গাভীর আশঙ্কাজনক অবস্থার খবর পেয়ে আমি উত্তর দেহেরগতি গ্রামের কৃষক ছবুর হাওলাদারের বাড়িতে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি গাভীটি প্রায় অচেতন অবস্থায় মাটিতে শুয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন না খেয়ে গাভীটা মারাত্মক রকম ডিহাইড্রেট হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল। এর মুমূর্ষু অবস্থা বিবেচনা করে আমি তাৎক্ষণিক স্যালাইনের মাধ্যমে পানিশূন্যতা পূরণসহ কয়েকটি ভিটামিন এবং এন্টিহিস্টামিন ওষুধ স্যালাইনের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করি। এমন ক্রিটিকাল কন্ডিশনে এই গাভীর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ১০ পার্সেন্ট বলেও মালিককে জানাই। তারা আমার কাছে তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা করেছিলেন আমি ইনজেকশনের মাধ্যমে গাভীটার জরুরি গর্ভপাত ঘটাই। যাতে তারা অন্তত সেটা জবাই করে বাজারে বিক্রি করতে পারেন। সকালে কোয়াক ডাক্তার দুলালকে ডেকেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা অপরাধ বিধায় কেউ রাজি হয়নি। তাছাড়া গাভীর শারীরিক কন্ডিশন এতটাই খারাপ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে সেটা গর্ভপাত ঘটানোর মত অবস্থাও আর ছিল না। এজন্যেই হয়তো ভুল বুঝে কিংবা ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আমাকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেছেন এবং আমার বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় গাভী মৃত্যুর অভিযোগ দিয়েছেন। তবে আমি এতে কিছু মনে করিনি।একজন চিকিৎসকের জীবনে এটাই ট্রাজেডি। এই রিয়েলিটি মেনেই আমাদের কাজ করতে হয়।'
বাবুগঞ্জ উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ মাহফুজ আলম বলেন, 'গর্ভবতী গাভীটি প্রেগন্যান্সি টক্সেমিয়া রোগে আক্রান্ত ছিল, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম কিটোসিস। এটি গর্ভকালীন এমন একটি অবস্থা যেখানে গাভী খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে ডিহাইড্রেট হয়ে নেতিয়ে পড়ে এবং জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। গাভীটি প্রেগন্যান্সি টক্সেমিয়ার থার্ড স্টেজে ছিল। এই স্টেজ থেকে রিকভারি একেবারেই অসম্ভব। এটি প্রাইমারি স্টেজে ধরা পড়লে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরের ফ্লুইড দিয়ে সেই সাথে কিছু ভিটামিন, এন্টিহিন্টামিন এবং প্রয়োজন হলে এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি স্টেজে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে সুস্থ হওয়ার চান্স থাকলেও থার্ড স্টেজে চলে গেলে সেখান থেকে আর কোনো ওষুধ দিয়েই বাঁচানো সম্ভব নয়। এখানে ভুল চিকিৎসার কোনো ঘটনা তদন্তে পাওয়া যায়নি। গাভীর কিটোসিসের জন্য যে স্যালাইন এবং ইনজেকশন নির্দেশিত উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম সেটাই দিয়েছেন। তবে থার্ড স্টেজে থাকায় কোনো ওষুধই গাভীর শরীরে রেসপন্স করেনি। এই পর্যায়ে কোনো চিকিৎসকের কিছু করার থাকে না। মৃত্যু নিশ্চিত জানলেও পেসেন্ট বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টাটা করতে হয় তাকে। তাছাড়া অভিযোগকারী ছবুর হাওলাদার লিখিত অভিযোগে বেশকিছু অসত্য তথ্য দিয়েছেন। প্রথমত তিনি লিখেছেন রাতে ইনজেকশন দেওয়ার সাথেসাথেই গাভীটি মারা যায়। কিন্তু বাস্তবে গাভীর মৃত্যু হয়েছে পরদিন সন্ধ্যায়। উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহ আলম চিকিৎসা দিয়ে আসার পরে পরদিন সকালেও আরেক কোয়াক ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তাছাড়া অভিযোগে ১১টি ইনজেকশন দেওয়ার কথাও সত্য নয়। গাভীকে স্যালাইনের সাথে মিশিয়ে ৪টি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, যা সঠিক চিকিৎসা ছিল। এই ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে এন্টিবায়োটিক, এন্টিহিস্টামিন, পেইন কিলার আর ভিটামিনসহ সর্বমোট ৪ ধরনের ইনজেকশন আছে। তিনি ১১টি ইনজেকশন পাবেন কোথায়?'

| উপদেষ্টাঃ আলহাজ সিরাজ আহমেদ | প্রকাশক ও সম্পাদকঃ রফিকুল ইসলাম রনি | প্রধান সম্পাদকঃ ইব্রাহিম রুবেল | বার্তা সম্পাদকঃ আব্দুল বারী |
যোগাযোগঃ
৬/সি, আনেমা ভিস্তা (৭ম ফ্লোর), ৩০ তোপখানা রোড, ঢাকা ১০০০।
মোবাইলঃ ০১৮২৪২৪১০২৩, ০১৭১৯২৬৪০৪৫