
শাহজাহান হেলাল, ফরিদপুর প্রতিনিধি।। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের সালামতপুর গ্রামে বর্তমান রউফ নগর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর স্মৃতিচিহ্ন জন্মভিটা পড়ে রয়েছে অযত্ন আর অবহেলায়।
রউফ নগরের জন্মভূমি বাড়িটি রয়েছে তার স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। সেই বাড়িটি অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংস হতে চলছে। এরই মাঝে দু’একটি বাদে দরজা-জানালাসহ সবকিছুই চুরি হয়ে গেছে। এদিকে বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের বাড়ি যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটিও পাকা করা হয়নি স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও। প্রতিবছরই মধুমতির ভাঙ্গনের কবলে পড়ে যাতায়াতের সড়কটি চলাচলে অনেকটা দুরুহ হয়ে পড়ে। প্রতিবছরই রাস্তার ভাঙ্গন ঠেকাতে সিসি বøক ফেলে রক্ষার চেষ্টা করা হয়। ফলে শুধু গ্রামবাসীই নয়,দুর-দুরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের চরম ভোগান্তিও পোহাতে হয় তার স্মৃতিচিহ্ন বাড়ি ও তার নামের গ্রন্থাগারটি দেখতে। ভ্রমন পিপাসী ও পর্যটকরা মুন্সি আব্দুর রউফের বাড়িটি দেখে শুধুই হতাশ নন, তাদের অন্তরে ব্যথা অনুভব করেন। এছাড়া মুন্সি আব্দুর রউফের মা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বোন দু’জনের মধ্যে একজন সালামতপুর গ্রামে থাকলেও অন্যজন থাকেন পাশের জেলা রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি উপজেলার সাংগুড়া গ্রামে। একমাত্র পালক ভাই মারা গেছেন ক’বছর আগে। বাড়ির পাশের বোনটি থাকেন অতি দুঃখ কষ্টে। প্রতিবছর বীরশ্রেষ্টর জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন কেটে যায় নামকাওয়াস্তে প্রশাসনের কর্মসূচীর মাধ্যমে। মুন্সি আব্দুর রউফের মা মকিদুন্নেছা মারা যাবার পর আর তেমন একটা খোজ-খবর নেন না কেউ। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী ও ভ্রমনকারী দর্শনার্থীরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দ্রæত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিন সালমতপুর গ্রাম ঘুরে কথা হয় স্থানীয়দের সাথে। তারা বলেন, মধুমতি নদীর তীরের সালামতপুর গ্রামটি এখন রউফনগর হিসাবে পরিচিত। এ গ্রামের সূর্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রæ বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে জীবন দিয়ে গেছেন তিনি। জাতির শ্রেষ্ঠ এ সন্তানের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে তাকে ভূষিত করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে। দেশবাসীর কাছে মুন্সি আব্দুর রউফ একটি গর্ব ও ভালবাসার নাম। প্রতি বছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে উঠে আসে রউফের আত্মত্যাগের অবদান। এ গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠের নামে রয়েছে একটি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার। বছরের বিভিন্ন সময় দুর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতি বিজড়িত বসতভিটা ও যাদুঘর দেখতে। কিন্তু তারা এখানে এসে হতাশ হন। যাদুঘরে শুধু রয়েছে তার ব্যবহৃত দুটি বাটি আর একটি থালা। আর নেই কোনকিছু। তার জন্মভিটা বাড়িটি রক্ষায় নেই কোন উদ্যোগ। প্রত্যন্ত এ গ্রামটিতে আসতে রাস্তার অবস্থা খারাপ থাকায় অনেকে কষ্ট করে এসে হতাশ হন তার জন্মভিটা স্মৃতিচিহ্ন বাড়িটি দেখে।
স্থানীয়রা জানান মুন্সি আব্দুর রউফের মা মকিদুন্নেছা মারা গেছেন। বোন জোহরা বেগম থাকেন স্মৃতি বিজরিত গ্রাম রউফ নগর গ্রামে সালামতপুেরই। অন্য অরেক বোন হাজেরা বেগম থাকেন স্বামীর বাড়ি রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলা সাংগুড়া গ্রামে। আর পালক ভাই আইয়ুব আলী থাকেন আড়পাড়া গ্রামে।
রউফনগর গ্রামের রফিক হোসেন বলেন,ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কামারখালি থেকে মধুমতি নদীর পাড় দিয়ে আসতে হয় এ রউফনগর গ্রামে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সড়কটি বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। প্রতিবছর সড়কটি রক্ষায় মধুমতি নদীর পাড়ে বোল্ডার ও সিসি বøক এবং বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে রক্ষার চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। টেকসই পাকা সড়ক না হবার কারণে গ্রামবাসীর মনে রয়েছে চরম ক্ষোভ। কামারখালী বাজার থেকে মধুমতি নদীর তীর পর্যন্ত কিছুটা পথ কার্পেটিং বা পিচঢালাই। এরপর ফুলবাড়িয়া থেকে ইট বিছানো সড়ক। এ সড়ক দিয়ে রউফনগর, গন্ধখালী, দয়ারামপুর, কোমরপুর,বকশিপুর,মাধবপুর,চরপুকুরিয়া মধুমতি নদীর পশ্চিমের ওপারের মাগুরা জেলার মহম্মদপুরসহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ চলাচল করেন। গন্ধখালি গ্রামের নাসির হোসেন বলেন,ছোটবেলা থেকেই রাস্তার এমন দশা দেখছি। শুনি সড়কটি পাকা হবে,কিন্তু পাকা হবার লক্ষন দেখতে পাচ্ছিনা। বকশিপুর গ্রামের মো.বিল্লাল বলেন,প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে কাজে যেতে হয়। রাস্তায় চলাচলে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হবার উপক্রম। এলাকার মানুষ আকাবাকা উচু-নিচু রাস্তায় যাতায়াতে ভীষণ কষ্ট হয়। আর নারীদের চিকিৎসার দরকার হলে বিরম্বনার শেষ নেই।
সালামতপুর গ্রামের শিক্ষার্থী পারভেজ বলেন,বীরশ্রেষ্ঠর বাড়িতে থাকার মত কোন পরিবেশ নেই। জানালা-দরজা সব চুরি হয়ে গেছে অনেক আগেই। টিউবওয়েলের মাথা পর্যন্ত চুরি হয়েছে। আগে আলো জ্বালানো হলেও এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এভাবে থাকলে কিছুদিন পরে বাড়ির ধ্বংসবিশেষও খুজে পাওয়া যাবে না। এছাড়া সালামতপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠের নামে রয়েছে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরি যা সপ্তাহে ৫ দিন খোলা থাকে। সেখানে খুব কম মানুষের উপস্থিতি হয়। বেশীভাগ সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। রিপন হোসেন নামের একজন কেয়ারটেকার দেখাশুনা করেন বইপত্রগুলি।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের বড়বোন জোহরা বেগম আক্ষেপ নিয়ে বলেন,‘এটা যে একটা বীরশ্রেষ্ঠের বাড়ি,দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কত মানুষ কষ্ট করে আসে তারাও আফসোস করেন। বাড়ির সব কিছুই এখন অকেজো। বীরশ্রেষ্ঠের নামে একটি প্রাইমারি স্কুলের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম সরকারের কাছে,সে কাগজ কোথায় আছে কিছুই জানি না। মা মকিদুন নেছা জীবিত থাকাকালীন আমাদের একটু খোঁজ খবর রাখলেও এখন তেমন খোঁজ নেননা কেউ। দুঃখ কষ্টের মাঝে আগেও ছিলাম এখনো আছি।
মধুখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার রওশনা জাহান জানান আমি সবেমাত্র যোগদান করেছি,উন্নয়নের দিকে এখনই নজর দিতে পারছিনা। বিগত দিনে মধুমতি নদীর ভাঙ্গনের কারণে রউফনগরে যাতায়াতের সড়কটির তেমন উন্নয়ন করা সম্বভ হয়নিঢ়। অসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রথম প্রাইরোটির ভিত্তিতে কাজ করছি। মুন্সি আব্দুর রউফের বাড়ি ও গ্রন্থাগারের উন্নয়নের বিষয়ে কি করা যায় তা দেখা হবে। তার জন্মদিন এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কি করা যায় তা দেখা হবে।
প্রসঙ্গত, মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে বর্তমান রউফ নগর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থাণীয় মসজিদের ইমাম এবং মাতা মুকিদুন নেছা ছিলেন গৃহিনী। রউফের দুই বোন জোহরা বেগম এবং হাজেরা বেগম। মুন্সি আব্দুর রউফ মারা যাবার পর আইয়ুব আলী নামের এক পালক ভাই ছিল তাদের। ১৯৫৫ সালে তার পিতা মেহেদী হাসানের মৃত্যুর পর আব্দুর রউফ তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। সংসারের হাল ধরতে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া ছেড়ে ১৯৬৩ সালের ৮ মে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আব্দুর রউফ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ছয় মাস পরে তাঁকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে কুমিল্লায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং-এ বর্তমানে বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন ১১ বিজিবি তিনি কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দেশের হয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সি আব্দুর রউফ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পুর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ৮ এপ্রিল মতান্তরে ২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে বিধ্বস্ত করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসে। এসময় তার সাথের অন্য সদস্যদের সড়ে যেতে সময় দিয়ে নিজে একাই বাঙ্কারে গুলি চালাতে থাকেন। এসময় শত্রæপক্ষের লঞ্চ থেকে মর্টারের একটি শেল তার বাঙ্কারে এসে পড়ে তিনি শহিদ হন। সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়। তাকে পাবর্ত চট্টগামের রাঙামাটির নানিয়ার চরে দাফন করা হয়েছে।


