এলিসন সুঙ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি :- মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে পরিকল্পিত ভাবে অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করা হয় । প্রতি বছর এই দিনটি আসলে সারা জেলার মানুষের চোখে ভেসে উঠে সেই রাতের কালো আকাশে দাবানলে লাল হয়ে উঠা সেই ভয়ানক দৃশ্য। একে একে ২৩ টি বছর কেটে গেলেও পাওয়া  যায়নি ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে ক্ষতির ১৪ হাজার কোটি টাকা।
সেই ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন সরকার এসেছে।

তবে ২৩ বছর ধরে কোনো এক অদৃশ্য কারণে ক্ষতিপুরনের টাকা আদায় করা হয়নি। আর ২৩ বছর ধরে এই দিনটি নানান কর্সসূচী পালনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে আসছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সামাজিক সংগঠনগুলো।

১৯৯৭ সালে ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ১নং অনুসন্ধান কূপ খননকালে হঠাৎ করে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।এই বিস্ফোরণের প্রকট শব্দে কেঁপে উঠে কমলগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন স্থান। বিস্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা,এতে করে বন ও পরিবেশের জীববৈচিত্র, ঢাকা-সিলেট রেলপথ,শমসেরনগর শ্রীমঙ্গল সড়কপথ  ফুলবাড়ি চা বাগান, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ীঘর, পানের বরজ এলাকা ও পিডিবির ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বৈদ্যুতিক লাইন।এছাড়াও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলাকার ২৮টি চা বাগানের।

প্রায় ছয় মাস বন্ধ ছিলো শমসেরনগর- কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল- ঢাকা সড়ক ও ঢাকা-সিলেট সরাসরি রেল ও সড়ক যোগাযোগ । শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিলোমিটার (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০টি চা বাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। প্রায় ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি হয়।

এতে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়  ও প্রায় ৫০ একরের গাছ-গাছালির আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধরা হয়।

সবকিছু মিলে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্ত বন ও পরিবেশের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানিসমূহের টালবাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ২৩ বছরে ৩টি কোম্পানির হাত বদল হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

মাগুরছড়ার এই ট্রাজেডির তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে আসে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনা দায়িত্বহীনতা অবহেলা ও ত্রুটির কথা। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে স্থানটি রাতারাতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়ে উঠে।

মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বলে নির্ধারণ করা হয়। গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালেরই ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে দুটি ভলিউমে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও তা বিতরণের বিষয়ে তিন সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটি, উপকমিটিকে জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কমিটির তদন্তে অক্সিডেন্টালের কাজে বেশকিছু  ত্রুটি ধরা পড়ে। অক্সিডেন্টালের কর্মকর্তারা দুই থেকে তিনটি ত্রুটির বিষয়ে আপত্তি জানালেও বাকিগুলো স্বীকার করে নিয়ে তদন্ত রিপোর্টে সই করেন।

কিন্তু, গ্যাস ফিল্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি পরিশোধ না করেই কোম্পানিটি আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনিকলের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ইউনিকলও কিছুদিন কাজ করার পর ফের আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়।

ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ছোট-বড় ৩৯টি চা বাগানের ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকা। এছাড়া বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২ হাজার ফুট রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস বাবদ ক্ষতি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা, সড়ক পথ বাবদ ২১ কোটি টাকা, গ্যাস পাইপ লাইন বাবদ ১৩ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ লাইন বাবদ ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা, খাসিয়া পুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজ বাবদ ধরা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা ও বাস মালিকদের রাজস্ব ক্ষতি ধরা হয়েছে ১২ লাখ টাকা।

বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূগর্ভস্থ গ্যাসের পরিমাণ ৪৮৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ এবং এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ ধরা হয়। উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৪ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও মাগুরছড়া ট্রাজেডির ২৩ টি বছর অতিবাহিত হলেও মার্কিন এই কোম্পানির কাছ থেকে আজও মেলেনি ক্ষতিপূরণ।

এবিষয়ে পরিবেশ বাদি সমাজসেবা মুলক সামাজিক সংঘঠন পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটির কমলগঞ্জে র সভাপতি মোনায়েম খাঁন বলেন কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারনে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যতাযত ক্ষতিপূরণ পায়নি।তিনি আরও বলেন তার সংঘঠন বিষয়টি নিয়ে প্রতিবছর মানববন্ধন স্বারকলিপি প্রদান সহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে।

Share.
Exit mobile version