কোভিড-১৯ (COVID-19) । পূর্ণ লিখলে যা হয়- Corona Virus Infection Disease। এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয় ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে চীনের উহান শহরে। প্রথমে ভাবছিলাম – চীন, সেতো অনেক দূর। উহান শহর ওটাতো চিনিই না। যাক, ওটার উৎপত্তিস্থল উহানে, ওখানেই বোধ হয় শেষ হবে। আর যদি ২/৪ জন মারা যায় তো কি আর করা। কিন্তু এই যমদূত যে আস্তে আস্তে সারাবিশ্ব গ্রাস করবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি। আজ ১৫ এপ্রিল/২০ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ১,২৮,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। যে ভাবে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে এই সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যেতে বোধ করি বেশী দিন লাগবে না, যা কখনো কামনা করি না।

ভাবতে ভাল লাগে – ৭ মার্চ/২০ পর্যন্ত বাংলাদেশ করোনামুক্ত ছিল, যদিও পার্শবর্র্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এর সংক্রমন আগেই শুরু হয়েছিল। পরিতাপের বিষয় – ৮ মার্চ/২০ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। আই ই ডি সি আর এর মাননীয় পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, রোগীটি ইতালী ফেরৎ জনৈক প্রবাসীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিপদের বিষ বাস্পের প্রবাহ এখান থেকেই শুরু। এর আগে চীনের উহান থেকে যারা এসেছিলেন তাদেরকে আশকোনো হজ্ব ক্যাম্পে Compulsory quarantine এ রাখা হয়েছিল। এতে আগত যাত্রী এবং স্বজনেরা অনেকে বিরক্ত বা নাখোশ হয়েছিলেন। যা হোক একটু গাদাগাদি হলেও করোনার ছোবল থেকে তারা অনেক দূরে সরে এসেছেন এটা ভেবে স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু এর পরের কাহিণী বড় করুন। ইতালী, স্পেন, সৌদি আরব, ওমান, মালয়শিয়া, দুবাই, কাতার ইত্যাদি দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ প্রবাসী আসলেন। ঐ সময়ে ইতালীতে করোনার সংক্রমন সব চাইতে বেশী ছিল। তাদের অনেককে আশকোনা ও পূবাইলে ১৪ দিন Quarantine এ নিয়ে যাওয়া হলো। অন্যান্য প্রবাসীদের সবাইকে ১৪ দিন নিজ বাড়ীতে Quarantine এ থাকতে বলা হল। বিশেষ করে ইতালী ফেরৎ প্রবাসীরা আশকোনা বা পূবাইলে থাকতে নারাজ। পুলিশের প্রতি তারা মারমুখো হয়েছে, রীতিমত রনাঙ্গন সেখানে। বিশৃংখলার বহর এখানেই শেষ নয়। পূবাইলে তারা মেখডুবি রিসোর্ট কেন্দ্রের গেটের তালা ভেঙে পুলিশের উপর চড়াও হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মোতাবেক করোনার বিস্তার রোধে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন ছাড়া বিকল্প কিছুই নাই। অথচ প্রবাসীরা সেটা মানছে না। তারা চায় ফাইভ ষ্টার হোটেল। মাননীয় পররাষ্টমন্ত্রী মহোদয় বোধ করি এ জন্যই বলেছেন “প্রবাসীরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে যায়”। ধরা যাক হোটেল ভাড়া প্রবাসীরাই দেবেন। কিন্তু করোনা ঝুকির ব্যক্তিকে কোন হোটেল কি সিট দেবে? আর দিলেও লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর জন্য লক্ষ লক্ষ সিটের কোন ফাইভ ষ্টার হোটেল কি ঢাকা শহরে আছে ? তা হলে এর বিকল্প ছিল বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্œ করে দেয়া। পরিশেষে সেটা করা হয়েছে কিন্তু ততক্ষনে অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে অর্থাৎ কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।

ভাবলে শরীর সিউরে উঠে দিনে দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আর দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এ থেকে পরিত্রানের উপায় খোঁজা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। এ থেকে বাঁচার জন্য মানণীয় প্রধানমন্ত্রী দফায় দফায় সরকারী ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজ গৃহে থাকতে বলেছেন। মানণীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থার তড়িৎ উন্নয়নের চেষ্টা করছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মানণীয় মহাপরিচালক মহোদয় হু (WHO) এর নির্দেশনা, করোনা প্রতিরোধের উপায় বলছেন প্রতিদিন। করোনা সনাক্ত, মৃত্যুর সংখ্যা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছেন আই ই ডি সি আর এর মানণীয় পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। মাঠ পর্যায়ে সরকারী নির্দেশনা মানাতে আইন শৃংখলা বাহিনীর নাভিঃস্বাস উঠে যাচ্ছে। অথচ অতীব দুঃখের বিষয় আমরা কারও কথা শুনছিনা।
কারও বিরাগভাজন হলেও এখানে সত্য কথা না বলে পারছি না। সত্য কোন প্রশ্নের সামনে দাড়াতে ভয় পায় না। মিথ্যার বড় ভয় প্রশ্নকে এবং সত্যকে। মানণীয় সাবেক অর্থমন্ত্রী মহোদয় যথার্থই বলেছিলেন – এদেশের ঋন খেলাপীরা নিঃর্লজ্জ। আমি বলছি আমরা বাঙালীরা কেউ কেউ বিশ্ব বেহায়া। এই বেহায়ার উদাহরন একটু পেছন থেকে দিয়ে আসি। উদাহরন- ১ঃ- প্রতি বছর অক্টোবর মাসে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২০/২২ দিন মাছ শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ঐ ২২ দিন গরীব জেলেরা যাতে কোনমতে খেয়ে বাঁচতে পারে এ জন্য তাদেরকে প্রতিদিন পরিবার প্রতি ২/৪ কেজি চাল সরকারী সাহায্য দেয়া হয়। তবুত্ত কোন কোন জেলে রাতের আধাঁরে চোরের বেশে মাছ ধরতে নামে। নৌপুলিশ ও কোষ্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়লে তাদের জাল পুড়িয়ে দেয়া হয়, জেল-জরিমানা ও করা হয় । এত কিছুর পরে আবারও তারা নদীতে জাল ফেলে। বলেন এদেরকে বিশ্ব বেহায়া বলা যা কি না? পরিতাপের বিষয় চাল ও তেল চোরেরা সর্ব কালের সর্বনিকৃষ্ট বেহায়া।
বর্তমান বেহায়া আমাদের অসচেতন নাগরিকেরা। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও সেনা সদস্যরা ২৪ ঘন্টা টহল দিচ্ছেন, মাইকিং করছেন সবাইকে ঘরে থাকার জন্য এবং নিস্প্রোজনে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য। প্রচেষ্টা এখানেই শেষ নয়। র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত অনেককে জরিমানা করছেন, কান ধরে উঠ-বস করাচ্ছেন। এত চেষ্টার পরেও থেমে নেই তাদের অকারণ বাইরে বেড়ানো। আবার কেউ কেউ তেড়ে আসছে আইন শৃংখলা বাহিনীর তদ্পরতার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে প্রাইভেট কারের কোন কোন আরোহী পুলিশের প্রতি এমন আচরণ করেছে তাতে মনে হয়েছে সে জমিদার আর পুলিশ তার চাকর। ভাব দেখে মনে হয় সমাজে অপরাধী চলে বীরদর্পে আর উৎপীড়িত থাকে তস্করের মত। সমাজ সমালোচনা করে, সমাধান দেয় না, সমাজ বিবাদ বাঁধায় মিমাংশা করে না। আমরা সেই ঘুনে ধরা সমাজের বাসিন্দা, সমস্যা তো সেখানে।

মানুষকে সচেতন করার সর্বাতœক চেষ্টা চলছে অবিরাম। জনাব নাসির উদ্দিন ইউসুফ, চিত্র নায়ক জনাব আলমগীর, জনাব ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধূরী, নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জনাব ইকবালসহ বেশ ক’জন গুনীজনও অংশ নিয়েছেন এর প্রচারনায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে আমরা কেউ কারও কথা শুনছি না। মা শুনছে না বাবার কথা, স্ত্রী শুনছেনা স্বামীর কথা, ছেলে শুনছে না মায়ের কথা। থাক, ও আর এক তুষের আগুন, ওতে ফু দেবার সময় এখন না। সমাজে শৃংখলা আনতে হলে আমাদেরকে কাউকে না কাউকে মানতে হবে, কারও না কারও কথা শুনতে হবে। অবস্থাটা এমন দাড়িয়াছে-একসাথে সবাইকে সচেতন করতে হলে এক একজন লোকের পিছনে এক একজন পুলিশ নিয়োগ দিতে হয়। অর্থাৎ ঐ হিসাবে ১৭ কোটি লোকের পিছনে ১৭ কোটি পুলিশ লাগে। এত পুলিশ কি কোন সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব? তা হলে কি ফেরেশতা আনবেন? খোদার ফেরেশতারা একমাত্র সর্বশক্তিমানের হুকুম ছাড়া কারও হুকুম তামিল করেন না।

তা হলে চলুন ফিরে যাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সামনে সুনাম করা ভদ্রতার লক্ষন নয় আর যে কথাটা সত্য তা না বললেও নয়। আমার কথা পরে বলছি, আগে বলি ৮ম শ্রেনী পুড়–য়া আমার শিশু পুত্রের কথা । এক রাতে খাবার খেতে খেতে চ্যানেল আই এর খবর দেখছিলাম। এক পর্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন ”বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না”। নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বললেন-”আপনারা গৃহহীনদের তালিকা করুন। আপনারা না দিলেও, আমি তাদের ঘর বানিয়ে দেব”। ছোট্র ছেলেটা আমাকে বলল ”আব্বু, বুঝতে পারছ, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) কি বলেছেন”। ছেলের কাছে ক্ষনিকের জন্য নির্বোধ হয়ে বললাম ”না তো বাবা তেমন কিছু বুঝলাম না” ছেলে বলল- ”তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যে তাঁর পিতা (বঙ্গবন্ধু)র যোগ্য সন্তান এটা তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) কথায় প্রমান দিয়ে গেলেন। তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেছেন- অন্য কেউ না দিলেও তিনি গৃহহীনে গৃহ দেবেন”।

এবার নিজের কথায় আসি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসক মহোদয়গণের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন – বেদে, হিজরা এরাও যাতে খেতে পারে তাও লক্ষ্যে রাখতে হবে। আমি ক্ষনিকের জন্য নিস্পলক নেত্রে তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম ১৭ কোটি মানুষের ভীড়ে, কারোনার হাহাকারে গুটি কতক হিজরা আর বেদের কথাও তিনি মনে রেখেছেন। এত বড় জনদরদী নেতা আর কে আছে? ভবিষ্যতে আর কেউ হবে কি? নিজ চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করি না। তা হলে আসুন জাতি-ধর্ম, দল মত নির্বিশেষে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা তাঁর কথা শুনি, তাঁর দিক নির্দেশনায় চলি, তবেই আমাদের বিপদ মুক্তির পথ সুগম হবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক- মাহমুদ হোসেন
অবঃ সরকারী কর্মচারী
ই-মেইলঃmahmudhossain000069@gmail.com

Share.
Exit mobile version