— এবং যতোদূর জানি

– ভীষ্মদেব বাড়ৈ

ঐশ্বর্য! পাশের কলেজে পড়ে। অনিমেষ জানতে পারে তার মাসতুতো বোন সুমিত্রার কাছ থেকে। ভীষণ দুরন্ত আর চঞ্চল। টেরাকাটা কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। লাভ-লকের বিলম্বিত পটভূমি তার আয়ত চোখের বেলাভূমিকে সর্বদা ঢেকে রাখে। উজ্জ্বল টানা টানা চোখ, কপালের আড়াআড়ি উজ্জল টিপ: কোন দিন সবুজ, কোনো দিন নীল, কোন দিন চন্দন-আভা রঙ। নীল রঙের শাড়ি তার ভীষণ পছন্দ। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কলারঅলা ব্লাউজ আর টিপ। মেয়েটি এ যাবত রবীন্দ্র, শরৎ, বিভূতি, মানিক, নজরুল মিলে শ’খানে নভেল পড়ে ফেলেছে। ত্রিশোত্তোর প্রায় সব আধুনিক কবিদের কবিতা তার মুখস্ত। চঞ্চলতার প্রচ্ছন্নতার মাঝে একটি সীমারেখা মেনে চলে সে। তুখোড় বিতার্কিক। ছেলেরা তাকে মনে মনে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু গা ঘেঁষতে ভয় পায়। মাসতুতো বোনের কাছ থেকে তার কথা শুনে অনিমেষ মনে মনে ভীষণ ঐশ্বর্যের প্রেমে পড়ে যায়। অনিমেষ কবি এবং সঙ্গীত শিল্পী। অনিমেষ মনে মনে গুনগুন করে গান গায়-
‘তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে,
বেদন জাগে গো—-
না চিনিতেই ভালোবেসেছি।’

কলেজের এক বিতর্ক সন্ধ্যায় অকস্মাৎ তাদের দু’জনের মুখোমুখি দেখা হয়। দু’জনে বিপরীত দলের দলপতি, প্রধান বক্তা। কি প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের লাবন্য! নীল শাড়িতে স্বর্গের দেবযানী! অনিমেষ অন্তর্মুখী মানুষ, আর কোন দিন তার সাথে দেখা হয়নি। অনিমেষ নীল রঙের একটি ডায়েরিতে কবিতা লিখে চলে, তার অনাগত ঐশ্বর্য নামে। মেঘদূত জমিয়ে তোলে মনের চেরাপুঞ্জিতে।

দু’বছরের মাথায় মাসতুতো বোন সুমিত্রা একদিন বলল- জানো দাদা, ঐশ্বর্যের অমতে তার বাবা তাকে এক অধ্যাপকের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো, বছর দুয়েক সংসার করার পর তার স্বামী হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যায়। ঐশ্বর্য এখন বিধবা, একটি কোলের শিশু নিয়ে ভীষণ অসহায়! অনিমেষ তার নীল ডায়রিতে কবিতা লিখে চলে। মনের ভাষা চোখের জলে ভিজে যায়।

চাইলেই হয়তো পারতো কিন্তু, সংসার, সমাজ আর লোকলাজের ভয়ে অনিমেষ কোন দিন তার কাছাকাছি যেতে পারেনি। আমরা জানতে পারি অনিমেষ আর কোন দিন বিয়ে করেনি। হঠাৎ একদিন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অনিমেষ। বছর বিশেক পরে অনিমেষ দেরাদুন থেকে ফেরার পথে অদূরে ট্রেনের কামরায়, এক তরুনকে নিয়ে এক পরিশুদ্ধ বিধবা, একটু ব্যতিক্রম, একটু আলাদা- তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যতা চোখে পড়ার মতো। তরুনটি মাঝে তাকে মা বলে তাকে সম্বোধন করছে। তিনি একমনে পড়ছেন মৈত্রেয়ী দেবীর নহন্যতে। বেঞ্চিতে পাশেই গুছিয়ে রাখা গীতাঞ্জলি, তিথি ডোর, কাছের মানুষ, প্রথম আলো। ছোট সাউন্ডে বাজছে এইচএমভির রেকর্ড প্লেয়ারে- অখিলবন্ধু ঘোষের গান! ভদ্রমহিলা শরতের বিচ্ছিন্ন অবকাশ ঠেঁলে উদাস মনে অসীম আকাশের দিকে বারবার চাইছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে অনিমেষকেও লক্ষ্য করছিলো। ট্রেন চলছে——

দু’স্টেশন বাদে অনিমেষ নেমে গেল। কিন্তু মনের বেখেয়ালে ট্রেনের কামরায় রেখে গেল আজীবনের সাথী কবিতার ‘নীল ডায়েরী’। ঐশ্বর্য লক্ষ্য করলো। কিন্তু যখন লক্ষ্য করলো, ততক্ষণে অনিমেষ অলক্ষ্যে চলে গেছে। ঐশ্বর্য ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো। একটু ভিতরে চোখ পড়তেই ঐশ্বর্য প্রায় পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গেল, কলেজের সেই বিতর্ক সন্ধ্যার আপাদ বর্ননা। অনিমেষ অংশগ্রহনকারী সবার নাম লিখে রেখেছিল ডাইরীর প্রথম পাতায়। ঐশ্বর্যের নাম লেখা ছিলো- সোনালী কালিতে একটি আলাদা পাতায়। ঠিক নিচে একটি গোলাপ ফুল, তার নিচে- একটি তিন লাইনের ইংরেজী কবিতা-
” It’s our first meet,
I meet with heart,
Your shadow writes a poem
In my eyes.”

– To Aishwarja

ডায়েরীর কোথাও ঠিকানা পাওয়া গেল না। ঐশ্বর্য কাঁদছে। অনন্তের পথে চলছে ট্রেন—–

কয়েক মাস পরে মাসতুতো বোন সুমিত্রা অনিমেষের পুরানো ঠিকানায় চিঠি লিখলো-
দাদা, ঐশ্বর্য পুনরায় নিজের ইচ্ছেতে আবার এক বয়স্ক লোককে বিয়ে করেছিলো। স্বামী জলধর রায় চৌধুরী, বিশাল এক ওষুধ কোম্পানীর মালিক। এর আগে একটি সংসার ছিলো, বউ-বাচ্চা ছিলো। ঐশ্বর্যকে আলাদা বাসা ভাড়া করে দিয়েছিলো জলধর। অনেকটা টাকার জোরে আলাদা সংসার পেতেছিলো। কিন্তু কোন দিন ঐশ্বর্যকে স্বীকৃতি দেয়নি, মন থেকে ভালোবাসেনি। জলধর ছিলো এডিক্টেড। মোহ কেটে গেলে জলধর ঐশ্বর্যের দিক হথে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিরুপায় ঐশ্বর্য সবেধন নীলমনি ছেলেকে নিয়ে অজানার পথে নিরুদ্দেশ হয়েছে। কেউ আর তার খোঁজ পায়নি!

অনিমেষ দু’মাস পরে পুরানো আস্তানায় গিয়ে চিঠিখানা পেল। পৃথিবীর সমস্ত হাহাকারে আজ এতো বছর পরে যেন ঐশ্বর্যের জন্য মন প্রাণ কেঁদে-কেটে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যে ঐশ্বর্যের কপালে অনিমেষ একদিন রাজটীকা দেখেছিলো- সে আজ দ্বিতীয় বৈধব্য নিয়ে এক ফেরারী ভিখারিনী!

অনিমেষ পৃথিবীর তল হারিয়ে আবার অতলে হারিয়ে গেল! নিরুদ্দেশ অনিমেষ!
নিরুদ্দেশ ঐশ্বর্য!
আমরা ঐশ্বর্য বা অনিমেষের আর কোন খোঁজ জানতে পারিনি। অবশেষে অনিমেষ আর ঐশ্বর্য অন্তঃহীন নিরুদ্দেশের পথে এক হতে পেরেছিল কিনা তাও আমাদের অজানাই থেকে গেল! কতো ঐশ্বর্যরা এখনো এভাবেই রাত-দিন কেঁদে চলছে সময়ের নিয়মে, এ পৃথিবীতে কে কার খোঁজ রাখে—–?

(০৪/০২/২০২০, রাত দুটো, রূপ-কর্ণ নিবাস, যশোর)

Share.
Exit mobile version