বিশেষ প্রতিনিধি।। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে দেশের ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। বিশেষ করে, দ্রুত এগিয়ে চলছে ২৪শ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গ্রিডলাইনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে কি না- এ নিয়ে রয়ে গেছে শঙ্কা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে যদি গ্রিডলাইনের নির্মাণকাজ শেষ না হয়, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হওয়ার পরও রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা সম্ভব হবে না। প্রসঙ্গত একই কারণে সক্ষম হওয়ার পরও উৎপাদনে আসতে পারছে না পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গ্রিডলাইন ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর একটা বড় অংশ বাস্তবায়িত হচ্ছে ভারতের ঋণে। আর এ ঋণে ধীরগতির কারণেই যথাসময়ে নির্মাণ সম্পাদন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে বেরিয়ে এসে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করাও এ কেন্দ্রটি স্থাপনের অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে জ্বালানি হিসেবে তেলভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে,

সেগুলো থেকে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছে গড়ে ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকায়। আর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম পড়বে মাত্র ৩ টাকা থেকে সাড়ে ৩ টাকা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন এবং রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি রোসাটমের মধ্যে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়। রুশ সরকারের সহায়তায় নির্মিতব্য ২৪শ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে থাকছে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম দুটি ইউনিট। সব ঠিক থাকলে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০২২ সালের অক্টোবরে। দ্বিতীয় ইউনিটটি আসবে এর এক বছরের মধ্যেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বেশকিছু প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে একমাত্র সরকারি কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ওপর।

বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রূপপুরের বিদ্যুৎ দেশের অন্তত ১৩টি জেলায় পৌঁছে দিতে গ্রিডলাইন নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। এ অর্থে স্থাপন করা হবে অন্তত ৬১০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব তহবিল (জিওবি) ১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, সংস্থার নিজস্ব তহবিল ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ ৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ হিসেবে এ অর্থ দেবে ভারত। ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় এ ঋণ দিতে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। তবে একাধিক সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ ছাড়ে ধীরগতি এবং নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সঞ্চালন লাইনের কাজ শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

বিষয়টি নিয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া আমাদের সময়কে বলেন, গ্রিডলাইন নির্মাণে ঋণ হিসেবে অর্থায়ন করবে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংকের অর্থছাড়সহ নানা প্রক্রিয়া শেষ করতে দেরি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এর পরও আমরা আশা করছি সময়মতো কাজ শেষ করতে পারব।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাক ফিড পাওয়ার সরবরাহের লক্ষ্যে রূপপুর-বাঘাবাড়ি ২৩০ কেভি ৬০ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন টার্নকী ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে চলতি বছরের ১৮ মে। এ প্রকল্পে পাইলিংয়ের কাজ শেষ। আমিন বাজার-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি ৫১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন, রূপপুর-ঢাকা (আমিন বাজার-কালিয়াকৈর) ৪০০ কেভি ডবল সার্কিট ১৪৭ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং বে-এক্সটেনশনের জন্য ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক টেন্ডার আহ্বান করেছে মাত্র।

পিজিসিবি বলছে, দর প্রস্তাবের কারিগরি আর্থিক মূল্যায়ন শেষ করে চুক্তি করতে হয়তো এ বছর শেষ হয়ে যাবে। এ ছাড়া রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি ১৪৪ কিলোমিটার সিঙ্গল সার্কিট সঞ্চালন লাইন, রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি ১০২ কিলোমিটার সিঙ্গল সার্কিট সঞ্চালন লাইন, রূপপুর-ধামরাই ২৩০ কেভি ১৪৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন, ২০ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং ট্রান্সমিশন লাইন এবং বিদ্যমান বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিবর্ধনকাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ফলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার পরও এ সময়কালের মধ্যে এসব গ্রিড লাইন প্রস্তুত করা অনেকটাই অসম্ভব।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আনোয়ার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মানকাজ আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হবে। তবে গ্রিডলাইন সময়মতো হবে কিনা, তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। তিনি বলেন, এটা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ ছাড় এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়ে গেছে। এর পরও সংশ্লিষ্টরা চেষ্টা করছেন সময়মতো তা সম্পাদন করার। তিনি বলেন, যদি ২০২২ সালের মধ্যে কোনো কারণে গ্রিডলাইন নির্মাণকাজ শেষ না হয়, তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে না। এটা হবে খুবই দুঃখজনক।

নির্ধারিত সময়ে গ্রিডলাইনের নির্মাণকাজ সম্ভব হবে কি না- এমন প্রশ্ন এড়িয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর আমাদের সময়কে বলেন, কবে নাগাদ গ্রিডলাইন বাস্তবায়ন করতে হবে সেটা আমরা পিজিসিবিকে জানিয়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করা হবে। তার আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই গ্রিড লাইনের কাজ শেষ করতে হবে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, কোনো কারণে যদি নির্ধারিত সময়ে গ্রিডলাইন বাস্তবায়ন না হয় তবে অবশ্যই এটি হবে এ প্রকল্পের জন্য একটা বড় ধাক্কা। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ রাশিয়ানরা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে ২০২৩ সালের মধ্যেই তা শেষ হবে।

এদিকে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এ কেন্দ্রটির ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হলেও অন্তত ছয় মাস পর আসে উৎপাদনে। এখন দ্বিতীয় ইউনিটের ৬০০ ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। কেন্দ্রটি আগামী মাসে উৎপাদনে আসার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তবে গ্রিডলাইনের কারণে কবে নাগাদ জাতীয় গ্রিডে এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ যুক্ত হবে, তা অনিশ্চিত।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের রূপপুর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও একই রকম ধারণা করছেন। তারা মনে করছেন, পিসিজিবি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনের জন্য পুরো প্রস্তুত হওয়ার পরও গ্রিডলাইনের জন্য উৎপাদন শুরু করতে পারবে না।

Share.
Exit mobile version