ব্যথার কষ্টে নেই দেশে এমন পরিবার পাওয়া দুষ্কর। একটা সময় বয়স্ক মানুষেরা নানা ধরনের ব্যথায় ভুগলেও এখন কম বয়সেও অনেকে বাতের সমস্যায় পড়ছেন। উপযুক্ত সময়ে, উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে অনেকের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। তবে এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ অনেকটা কম। কারণ বাত ব্যথা বা রিউমাটোলজির ওপর দক্ষ চিকিৎসক কম আসছেন। কারণ দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে নেই তাদের কোনো পদ।
অন্যদিকে বাতব্যথা রোগের বিস্তার রোধ করতে না পারায় দিনদিন রোগী বাড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রোগীদের ছুটতে হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। চিকিৎসকরা বলছেন, এদেশের অনেক মানুষ বাতব্যথা রোগের জন্য বাইরের অনেক দেশে গিয়ে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন, কোনো কোনো সময় প্রতারিতও হন। আবার অপচিকিৎসা ও অন্যান্য অনেক কারণে রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শেষে সাধারণ চিকিৎসা চালানোর সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হলো বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস। প্রতি বছর এই দিনটি বাতব্যথা বা আর্থ্রাইটিস বিষয়ে সচেতনতার জন্য পালিত হয়। সোমবার পালিত হওয়া দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘বাতব্যথা নিয়ন্ত্রণের এখনই সময়’।
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি একশজনে প্রায় ২৭ জন মানুষ কোনো না কোনো সময়ে বাত ব্যথার কষ্টে ভোগেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে। এই রোগে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আক্রান্ত হন এমন তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়। অধুমপায়ীদের থেকে ধুমপায়ীদের বাতের ব্যথার ঝুঁকি বেশি বলে তথ্য উঠে এসেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাতের কষ্টে থাকা রোগীদের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হলে এবং যথাযথ চিকিৎসা না পেলে রোগীরা কর্মক্ষমতা হারাতে পারেন।
এদিকে বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস উপলক্ষে বিএসএমএমইউর রিউমাটোলজি বিভাগের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এরমধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং করা হয়।
জানা গেছে, দেশে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউমাটোলজি বিভাগে বাতব্যথা বিষয়ে চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষকরা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিকেরও বেশি চিকিৎসক এই বিভাগ থেকে রিউমাটোলজিতে এমডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তবে সরকারি হাসপাতালে কোনো পদ না থাকায় এই বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসা সেবার বিস্তার ঘটানো যাচ্ছে না।
এদিকে বিএসএমএমইউর এই বিভাগ থেকে ২০০১ ও ২০১০ সালে বাংলাদেশে বাতব্যথা রোগের প্রকোপ নির্ণয়ের জন্য দুটি গবেষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়- শতকরা ২৬ দশমিক ৩ থেকে ২৬ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় বাতব্যথায় ভোগেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি ভোগেন। পুরুষের হার ২১ দশমিক ১ ভাগ ও নারীদের ৩১ দশমিক ৩ ভাগ (২০০১ সাল)। আশঙ্কার বিষয় যে ১০ বছরের ব্যবধানে নারীদের হার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়ে ৩৪ দশমিক ৫ ভাগ এবং পুরুষদের হার ১৮ দশমিক ৬ ভাগ হয়েছে (২০১০ সাল)।
এছাড়াও একই এলাকায় পরিচালিত এই দুটি গবেষণায় দেখা যায়, বাত ব্যথার সবচেয়ে বেশি প্রকোপ থাকে কোমড়ে। কোমড়ে ব্যথা বাত ২১ দশমিক ২ ভাগ ও ২০ দশমিক ১ ভাগ (২০১০ ও ২০০১ সাল)। এরপরে হাঁটু ব্যথা বাত ১৪ দশমিক ৭ ভাগ ও ১৪ ভাগ (২০১০ ও ২০০১ সাল)। কাঁধের জোড়ার বাত ৭ দশমিক ৪ ভাগ (২০১০ সাল) ও ১১ দশমিক ৫ ভাগ (২০০১ সাল), কুঁচকি বা হিপের বাত ৭ দশমিক ১ ভাগ (২০১০ সাল) ও ১৩ ভাগ (২০০১ সাল), গোড়ালির বাত ৬ ভাগ (২০১০ সাল) ও ৭ দশমিক ৭ ভাগ (২০০১ সাল)। বাতের কষ্টে ভোগা এসব মানুষের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে যেতে পারে না বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সবার প্রতি আহ্বান থাকবে আসুন সবাই সচেতন হই। সময় নষ্ট না করে যার যার অবস্থান থেকে এই রোগগুলো হতে আমাদের রোগীদের নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।’
সরকারের উদ্দেশে এশিয়া প্যাসিফিক লিগ অফ অ্যাসোসিয়েশনস ফর রিউমাটোলজির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের চিকিৎসাখাতের উন্নয়নে প্রতিনিয়ত নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাতের রোগীদের সুবিধার্থে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে রিউমাটোলজি বিভাগ চালুসহ পদ সৃষ্টি করতে হবে। এতে চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার হবে। রোগীরাও বেশি সেবা পাবেন।’
তথ্য সংগ্রহঃ শাহজাহান সরকার