আমি অপরিপক্ক দুটি পা নিয়ে জন্ম নিয়েছিলাম। এক অভিশপ্ত  জীবন। আমি কন্যা। আমি অপয়া। এমন সন্তান জন্মদিয়ে মা তার শ্বশুর বাড়ি টিকতে পারে নাই। মায়ের আশ্রয় হল মামা বাড়ি। আমার অভিশপ্ত জীবন মামার জন্য আশির্বাদ হয়ে দাঁড়াল। মহাসড়ক এর সংযোগ সড়কে আমাকে বসিয়ে দেয়া হল। সকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা। স্টিলের থালা ভরে যায় খুচরা টাকায়। আমি বড় হই। দেহ বড় হয়, শুধু অসাড় পা দুটো বড় হয় না।

কেউ পায়ে হেটে স্কুলে যায়,কেউ ফুটবল খেলে। আমার পৃথিবী আটকে যায় ব্যস্ত মহাসড়কে। কত রকম মানুষ। সবাই চলছে। আমি বসে বসে গুনি এক টাকা, দুই টাকা।

একদিন মামাকে বললাম ” মামা সন্ধ্যা বেলা এখানে আর বসব না। লোকে আমার গায়ে হাত দেয়।”

মামা হাসে। ” ধুর বোকা সন্ধ্যা বেলা লোক বেশি।টাকা বেশি পাইবি।”

মামাত ভাইয়ের বিয়ে হল। ফুলসজ্জা হল। সংসার হল। একাকীত্বের মাঝে আমার মধ্য কারো সঙ্গ পাবার তৃষ্ণা জন্মনিল। আমি চাইতাম কেউ আমাকে আলিঙ্গন করুক। একটু উষ্ণতার ছোঁয়া।

দেড় বছর পর ভাবীর কোল জুড়ে সন্তান। আমাকে সাত দিন দেখতে দেয়া হয়নি। কারন আমি নাকি অপয়া। আমার স্পর্শে নাকি নবজাতক এর অমঙ্গল হবে। অথচ এই সংসারের অনেক মঙ্গলিক কাজ হয়েছে আমার ভিক্ষালব্ধ টাকা দিয়ে।

ফুটফুটে বাচ্চা। সারাদিন এপাশ ওপাশ। এবার আমার মাতৃত্বের তৃষ্ণা। চরম সংকোচ নিয়ে মা কে বলেই ফেললাম

” মা আমি বিয়ে করুম””
মা হাসে।” পাগলী তোরে কিডা বিয়ে করবে?”

সেটা সত্যিই বিশ্ময়কর ছিল। ছোট খালা আমার জন্য বিয়ের পাত্র যোগাড় করেছে। দারিদ্র্যতার কারনে জব্বার এর স্ত্রী চলে যায়। রেখে যায় চার বছর বয়সী ছেলে দুলাল কে।

শর্তাধীন বিয়ে।জব্বার আর দুলাল এখানেই থাকবে। আমি সানন্দে রাজি হই। মামার তীব্র আপত্তি ছিল। এক সময়ে সেও রাজি।

আমার জীবনে নাটকীয় মোড় নিল। সুখের ঠিকানা আমি পেয়ে গেলাম।দুলাল কে আমার চোখের মনি করে রাখলাম। সংসার, সন্তান,মাতৃত্বের বিচিত্র আস্বাদনে আমি ভিজতে লাগলাম।

আজ প্রথম দুলাল আমাকে আম্মা বলে ডাকল। এ যে পরম পাওয়া। জব্বার মাঝেমাঝে নিখোঁজ হত। প্রশ্ন করলে উত্তর পেতাম না। আমার উপার্জিত টাকা দিয়েই সে চলত।

সব মেনে নেই দুলাল কে পেয়ে। বিশেষ বিয়ারিং এর চেয়ার ছিল,আমি বসে থাকতাম। । দুলাল সেই চেয়ার ঠেলে, মেঠো রাস্তা পার করে মহাসড়ক দিয়ে আসত।

দুলাল আজ চেয়ার ঠেলছে আর হিন্দি গান করছে। দুলাল বলল- আচ্ছা আম্মা তুমি ভাল শাড়ী কেন পিন্দ না?

আমি হাসি। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ উত্তর আমি দুলাল কে দিলাম

” ভাল শাড়ী পড়লে লোকে আমাকে ভিক্ষা দিব না”

আমি পাল্টা প্রশ্ন করি ” আব্বাজান এ গান কার কাছ থেকে শিখেছিস? ”

দুলাল যা বলল,তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

“”আম্মা আমারে গান দেখাইছে রফিক ভাই। তার মোবাইলে ইজ্জত মারা সিন আছে। আমারে আরো ল্যাংটা ছবি দেখাইছে। আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে।””

লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে থাকি। তার গায়ে হাত দিয়ে বললাম বাবা আর রফিক এর কাছে যাস না।

মূহুর্তের মধ্য দুলাল দাবী করে বসল ” আম্মা তাইলে আমারে রঙ্গিন মোবাইল কিইন্না দিবা। রফিক ভাইয়ের মত, টাচ করলে গান বাজে।

আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম। অতি দ্রুত তাকে রঙিন মোবাইল কিনে দিব। সাথে আমিও পাল্টা দাবী করি তাহলে তোকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাব। নিয়োমিত লেখাপড়া করতে হবে।দুলাল মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

বিকালে রফিক এর সাথে দেখা। রাগে আমার গা জ্বলছিল

” ওই জাউরা রফিক,তুই আমার মাসুম পোলারে কি সব দেখাস। লাত্থি দিমু তোকে””

অদ্ভুত ভঙ্গিতে রফিক হাসে।
” শালী লুলা। আমারে লাত্থি দিব। পরের ধনে পোদ্দারি, দুলাল কে হয় তোর?”

আমি প্রতিবাদ করতে পারি নাই। অক্ষমতার কোন জবাব হয়না। নত মাথা আরো নত হয়ে যায়। মহাসড়ক এর কোল ঘেষে সিম্ফনি মোবাইলের শো রুম। আমাকে ঢুকতে দিবে না। যখন জানল আমি ক্রেতা তখন বিক্রয়কর্মীদের আচরণ পাল্টে গেল। বিমর্ষ হয়ে ফিরে আসি রঙিন মোবাইলের দাম শুনে। একটা রঙ্গিন মোবাইলের এতো দাম!!

নিজের অক্ষম পায়ের দিকে তাকাই যা আমার জন্য আশির্বাদ। দুলাল এর স্বপ্ন পুরন হবে। মাস বা বছর এর হিসাব আমি কখনো করিনি। শনিবার আর মঙ্গল বার সাপ্তাহিক বাজার বসত। এই দুদিন আমার হিসাবে থাকে। এবার আমি দিন গুনতে থাকি কবে জানুয়ারি মাস আসবে। কবে আমার দুলাল স্কুলে যাবে।

জব্বার এর হাতে ২৫৯০ টাকা তুলে দিলাম। তাকে বললাম বিকালে মোবাইলে কিনে আনতে। দুলাল কে কিছু বুঝতে দিলাম না। লক্ষ্য একটাই ছিল দুলাল কে চমকে দিব। জব্বারও ভীষন খুশি।

রোজকার মত আজও দুলাল আমাকে রাস্তায় রেখে আসছে। কি সব হিজিবিজি গান গাইছে। মেঠো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দুলাল পিছনে ফিরে দৌড়।

বাপজান কই যাস?

দুলাল চিৎকার করে বলল

“মা পুকুরে শাপলা ফুটছে। লাল শাপলা। তুইল্লা আনি। তোমারে মালা গাথি দিমু। তাইলে ভিক্ষা বেশি পাইবা। আমারে রঙিন মোবাইল কিনে দিবা কলাম কিন্তু।

আমি হাসি আর ভাবি- ওরে পাগলু আজকেই পাবি রঙিন মোবাইল।

আমার দৃষ্টিসীমানার মধ্য। ফাঁকা মাঠে পুকুরে মাছ চাষ। সেখানেই শাপলা ফুটেছে। আমি জানতাম না দুলাল সাঁতার জানে না। চিৎকার করছি। কিন্তু আশপাশে কেউ ছিল না। সারাজীবন এর হিসাব পাল্টে গেল। হাটার জন্য দুইটা পা কিংবা একটা পা চাই।
হামাগুড়ি দিয়ে আমি একটু একটু আগাই। আমার দুলাল একটু একটু করে ডুবে যায়।

দুলাল এর লাশ উঠানে। সাপে কাটা দেহের মত ওর সারা গা নীলাভ। জব্বার কাঁদছে। একটি বারের জন্য জব্বার আমার দিকে অভিযোগ এর হাত তুলে নি।

চৌকিতে রাখা মোবাইল দেখেই বুকটা কেঁপে উঠে। এ ঘর আবার শুন্য। আবার যায়গা করে নিলাম সেই মহাসড়কে। কত মানুষ এ মহাসড়ক দিয়ে যায় আসে। প্রাণ হীন একটা বাসের চারটা পা,একটা রিক্সার তিন পা। আমার দেহে প্রাণ আছে। শুধু নীরব আমার পা। পা থাকলে আমিও হাটতাম,দৌড়াতাম। দৌড়ে গিয়ে আমি আমার দুলাল কে বাঁচাতে পারতাম।

Share.
Exit mobile version