রাঙা প্রভাত ডেস্কঃ নদী তীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন প্রকৌশলী সৈয়দ এমদাদুল হক। তিনি পানির সর্বনিম্ন লেভেল থেকে উপরিভাগের ঢালে ছিদ্রযুক্ত কংক্রিটের ব্লকের গালিচা এবং প্লাস্টিকের প্রলেপযুক্ত মোটা তার দিয়ে গালিচা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেন। তার প্রযুক্তিকে পানি বিশেষজ্ঞরাও কার্যকর বলে মত দিয়েছেন।

জানা গেছে, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত পরস্পর সংযুক্ত কংক্রিট ব্লকের গালিচা প্রয়োগ করে একটা পাইলট প্রকল্প সম্পাদনে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং এবং মানব হিতৈষী সংস্থাকে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। বর্তমানে এ গবেষণাকে এগিয়ে নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। তারা সহযোগিতা করলেই গবেষণাটি সফলতার মুখ দেখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার। আর পোল্ডার, হাওড়, নদী ও উপসাগর তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘের বাঁধ। এই তীরভূমি এবং বাঁধে প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষাকালে পানির প্রবল স্রোতে এবং বর্ষার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ভাঙন দেখা দেয়। এই ভাঙনে বছরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তীরভূমি রক্ষার জন্য সারা পৃথিবীতে যেসব রক্ষামূলক কাজ চলছে, তাকে দুটো শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ১. গালিচার মতো আচ্ছাদন বা কভার ও ২. অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তুর আচ্ছাদন বা কভার। বাংলাদেশে নদী, হাওর ও সাগর তীরবর্তী ভূমিকে পানির প্রবল ঢেউ থেকে রক্ষার জন্য দ্বিতীয় ধরনের আচ্ছাদন প্রয়োগ করা হয়। এজন্য প্রচুর পাথর, কংক্রিটের ব্লক ও বালিভর্তি জিও ব্যাগ দেওয়া হয়। প্রথম ধরনের আচ্ছাদন প্রয়োগ করার চেয়ে দ্বিতীয় ধরনের আচ্ছাদন প্রয়োগ করা সহজ। কিন্তু সহজ কাজ থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

সেই পাকিস্তান আমল থেকেই নদীভাঙন রোধে কংক্রিটের ব্লক ও বালুভর্তি ব্যাগ নদীতে ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা হয়ে আসছে। এই কৌশল সাময়িকভাবে ভাঙন ঠেকালেও তা দীর্ঘমেয়াদি সুফল দিচ্ছে না। বরং বারবার ভাঙন রোধে এই ব্লক ও বালুভর্তি ব্যাগ ফেলায় নদীর তলদেশ ভরে উঠে নাব্যসংকট সৃষ্টি করছে।

প্রকৌশলী সৈয়দ এমদাদুল হক জানান, প্রচুর সামগ্রী নিক্ষেপের কারণে ঢালের কাছে পলি জমে গেলে পরে বালুভর্তি ব্যাগ ফেলতে না হলেও নদীর গভীরতা কমে যায় আর নদীর ওপরের ঢালে পানির প্রবল ঢেউ আঘাত করতে থাকে। এরকম পরিবেশবিরোধী নদীশাসনের দ্বারা দেশের পানিসম্পদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিণামে অনেক নদী শুকিয়ে গেছে এবং এখনো শুকাচ্ছে, নাব্য হ্রাস পাচ্ছে ও নৌ-যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে, জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রকোপ বাড়ছে, তীরবর্তী গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে, তীরবর্তী এলাকায় আধুনিকায়ন কঠিন হচ্ছে, ড্রেজিং করে নদীর নাব্য দীর্ঘস্থায়ী করা যাচ্ছে না, প্রয়োগকৃত রক্ষামূলক কাজের জন্য প্রতি বছর প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, শহরাঞ্চলে উদ্বাস্তু মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ইমদাদুল হক ১৯৮৮ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। তিনি মানব হিতৈষী সংস্থা স্থাপন করে সেই সংস্থার নামে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় জাতীয় জাদুঘরে পরস্পর সংযুক্ত কংক্রিট ব্লকের গালিচা প্রয়োগ-সংক্রান্ত প্রদর্শনী উপস্থাপন করেন। সেই বছরেই এলজিইডি মিলনায়তনে প্রস্তাবিত কৌশল সম্পর্কে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি উদ্ভাবিত কৌশলের কার্যকারিতা তুলে ধরেন।

এরপর তিনি ২০১০ সালে পানির সর্বনিম্ন লেভেল থেকে নদীর তলদেশ পর্যন্ত ঢালে পরস্পর সংযুক্ত কংক্রিট ব্লকের গালিচা স্থাপনের কৌশল উদ্ভাবন করেন। এ নিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সেমিনারে নদীভাঙন প্রতিরোধে পানির সর্বনিম্ন লেভেল থেকে উপরিভাগে একধরনের গালিচা এবং তলদেশে আরেক ধরনের গালিচা সম্পর্কে উপস্থিত সবাইকে অবহিত করেন।

নদীভাঙন প্রতিরোধে পরস্পর সংযুক্ত কংক্রিট ব্লকের গালিচা ব্যবহার সম্পর্কে মৌলিক গবেষণায় সন্তুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৩ সালে একটা ছোট নদীতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দেয়। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন রক্ষায় ২০১৮ সালে মডেল টেস্ট সম্পন্ন করে। মডেল টেস্টে নতুন প্রযুক্তি কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রমাণিত হয়েছে এবং তূলনামূলক খরচের হিসেবে সাশ্রয়ী পরিলক্ষিত হয়।

ইমদাদুল হক জানান, সরকারের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং থেকে এ কাজ এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদগণও এ ব্যাপারে সহযোগিতায় আগ্রহী।

Share.
Exit mobile version