মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে, আজ বাড়তে পারে করোনার প্রকোপ, অতি ঠান্ডায় অনেক ফসলের ক্ষতির আশঙকা
রাঙাপ্রভাত ডেস্ক।। তীব্র শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশা। কিন্তু ঘরে বসে থাকলে তো সংসার চলবে না। তাই গরম পোশাক পরে বাইরে বের হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। গতকাল রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর এলাকা থেকে তোলা ছবি —আজাহার উদ্দিন
পৌষের শুরুতেই বেড়ে চলেছে শীতের তীব্রতা। এত দিন মেঘ আর কুয়াশার সঙ্গে শীতের লুকোচুরি চলছিল। অবশেষে শীত জেঁকে বসছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গতকাল শুক্রবার থেকে তাপমাত্রা দ্রুত কমছে। আর আজ শনিবার থেকে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহটি শুরু হতে পারে। ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে এর প্রভাব।
পুরো মৌসুমে তিনটি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, আজ শনিবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে। এই শৈত্যপ্রবাহ কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে। আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, শীতের তীব্রতার কারণে এই সময়কে মাঘের মতোই মনে হবে। কুয়াশার প্রাবল্য থাকবে, আছে বৃষ্টিরও সম্ভাবনা। সিনিয়র আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ সপ্তাহ খানেক বিরাজ করবে। রাতের তাপমাত্রা আরো এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস নামতে পারে। উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে পশ্চিমাঞ্চলেও শৈত্যপ্রবাহের বিস্তার ঘটতে পারে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসে বিস্তীর্ণ এলাকায় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করতে পারে।
এদিকে তিন মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা যায়, ডিসেম্বরের শেষ ও জানুয়ারিতে দুই থেকে তিনটি মৃদু (৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি (ছয় থেকে আট ডিগ্রি) ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে দুটি তীব্র (চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস) শৈত্যপ্রবাহে রূপ নিতে পারে। এদিকে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রাও ক্রমশ কমছে।
গতকাল থেকে উত্তরাঞ্চলের ওপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা এক দিনের ব্যবধানে দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে গেছে। তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে কয়েকটি এলাকায় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছে। গতকাল শুক্রবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।এছাড়া ডিমলাতেও তাপমাত্রা ১০-এর নিচে নেমে গেছে। গতকাল সেখানে ছিল ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। এদিকে ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৭.১ ডিগ্রি, ময়মনসিংহে ১১ ডিগ্রি, চট্টগ্রামে ১৭.৪ ডিগ্রি, সিলেটে ১৪.২ ডিগ্রি, রাজশাহীতে ১১ ডিগ্রি, রংপুরে ১০.৯ ডিগ্রি, খুলনায় ১৫.৫ ডিগ্রি এবং বরিশালে ১৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহে দুর্ভোগ বেড়েছে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের। রোগ-বালাইও বাড়ছে। করোনা মহামারি আরো সংকটে ফেলতে পারে।
করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা
শীতের প্রকোপ বাড়লে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, শীতকালে এদেশের মানুষের একসঙ্গে জড়সড়ো হয়ে বসার প্রবণতা এই সংক্রমণ আরো ত্বরান্বিত করবে। এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ঠান্ডা আবহাওয়ায় অ্যাজমা, সিওপিডিসহ ফুসফুসের রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়। করোনা ভাইরাসের মূল টার্গেটই যেহেতু ফুসফুস, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে অল্প পরিমাণ ভাইরাস প্রবেশ করেই বেশি ক্ষতি করতে পারে। তাপমাত্রার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও শীতে এর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ শুষ্ক আবহাওয়ায় এই ভাইরাস বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকে, তাই সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং অণুজীব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সানিয়া তাহমিনা বলছেন, যে তাপমাত্রায় এই ভাইরাসটি বাড়ে, সহজে সংক্রমিত করতে পারে বা নিজের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে পারে, শীতকাল সেটার জন্য আদর্শ। এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে যে, তীব্র শীতে এই ভাইরাসের বিস্তার বেশি হতে পারে। এই সময়ে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় হাঁচি, কাশি দেওয়া হলে বাতাসে জীবাণুর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা অনেকক্ষণ ধরে ভেসে থাকে। গরমের সময় সেটা যখন দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু শীতের সময় অনেকক্ষণ ধরে বাতাসে থাকে। ফলে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস পরিবারের যেসব ভাইরাস রয়েছে, সেগুলো ঠান্ডা আবহাওয়ায় বিস্তার বেশি ঘটে বলে দেখা গেছে। করোনা ভাইরাসের জীবাণুর ক্ষেত্রে যে নিউক্লিয় এনভেলাপ থাকে, অর্থাত্ ভাইরাসের বাইরে যে আবরণ থাকে, যেটি জীবাণুর জেনেটিক কণাগুলোকে ঘিরে রাখে সেটাকে বলা হয় লিপিড মেমব্রেন। এই আবরণটা তৈলাক্ত ধরনের। শীতকালীন পরিবেশে সেটা অনেকক্ষণ টিকে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলা হচ্ছে, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কঠোর হওয়ার কথা বলেছে সরকারের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটি।
বোরো বীজতলাসহ শাকসবজির ক্ষতির আশঙ্কা
তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বোরো বীজতলাসহ শীতকালীন শাকসবজির ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, টানা কুয়াশা, শীত ও হালকা বৃষ্টির কারণে মাঠে থাকা বোরো ধানের বীজতলা, সবজি, সরিষা ও গমের অপরিণত চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে কুয়াশা থাকলে বোরো বীজতলার ক্ষতি হতে পারে। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শামছুল হক জানান, আলুখেত রক্ষায় আগাম ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। আর সাদা পলিথিন দিয়ে বোরো বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। শীতে এই সমস্যা প্রতি বছরই দেখা দেয়। আগাম তথ্য দিয়ে বিষয়টি কৃষকদের জানানো হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতারা জানান, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় হিমেল বাতাস আর কুয়াশার প্রভাবে রবিশস্যের পাতা মোড়ানো ও পাতা পচে যাওয়া রোগ দেখা দিয়েছে। কুঁকড়ে গেছে শিম, আলু, করলা, মুলা, টম্যাটোসহ শীতকালীন বিভিন্ন শাকসবজি। নওগাঁয় কোল্ড ইনজুরিতে লাল হয়ে মরে যাচ্ছে ধানের চারা। কোথাও কোথাও নষ্ট হয়ে গেছে পুরো বীজতলা।