বিশেষ প্রতিনিধি।। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের অপর একটি দল স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় দফায় ভাসানচরের উদ্দেশে ক্যাম্প ছাড়ছেন। সোমবার ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের তিন ধাপে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। দুপুরে ভাসানচরের উদ্দেশে তাদের রওনার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

আগের মতো উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে তিন দলে ভাগ করে বাসগুলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছাড়বে। উখিয়ার মূল ক্যাম্প ছাড়াও পুরো ৩৪ ক্যাম্প থেকেই ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গারা ট্রানজিট পয়েন্টে আসতে শুরু করেছে রবিবার বিকেল থেকে। বাকিরা সোমবার সকালে এসে পৌঁছাবে। আর প্রথমবারের মতো এবারও রোহিঙ্গাদের ভাসানচর যাত্রা নিয়ে প্রশাসনের কেউ মুখ খুলছেন না। তবে, গতবারের মতো এবারও র্যাব-১৫ এবং অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বলে জানিয়েছে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র।

সূত্র মতে, স্বেচ্ছায় যারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাদেরই কেবল স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে। প্রথম যাত্রাতেও এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কেউ মুখ খুলতে চাননি। দ্বিতীয় দফেও একই ভাবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলছেন না তারা। তবে ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ার মতো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোববার সন্ধ্যার পর থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ট্রানজিট পয়েন্টে চলে আসে। তালিকাভুক্ত হওয়া অন্যরা সোমবার ভোর থেকে আসবে বলে অভিমত তাদের। আগে থেকে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুত রয়েছে। উখিয়া ডিগ্রী কলেজের মাঠ থেকে তিন ধাপে ৩০টি বাস ও ২০টি ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বোট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। ওখান থেকে পরদিন (মঙ্গলবার) সকালে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেওয়া হবে।

এর আগে, গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রায় এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গা ভাসানচরে গেছেন। আগে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে সমুদ্র উপকূলে আটক আরো তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছিল। এদের মাধ্যমে উখিয়া-টেকনাফে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা ভাসানচরের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করাচ্ছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝিরা জানান, অনেক রোহিঙ্গা পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচর যেতে উদ্যোগী হচ্ছে। তাদের নির্ধারিত সময়ে ট্রানজিট পয়েন্টে চলে গিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার বাস ধরছে।

আন্তর্জাতিক একটি এনজিওর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বার বার অভিযোগ উঠেছে এনজিওদের প্ররোচনায় রোহিঙ্গারা ভাসানচর যাচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গাদের ভাসানচর যাত্রায় কোন এনজিও মাথা ঘামাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের সরকার যেখানে রাখবে আমরা সেখানেই সহযোগিতা দেব। আমরা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে নয়।

এদিকে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর জাহাজ। চরে নেয়ার প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ অবস্থানেই তারা রান্না করার ব্যবস্থার উদ্যোগ রয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেওয়ার আগে পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ, ফ্রেন্ডশিপ, এসএডব্লিউবি, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল : বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সংস্থা, আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেলথ দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসভা কেন্দ্র, কারিতাস বাংলাদেশ, সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সিডিডি, মুক্তি- কক্সবাজার, ভলান্টারি অরগানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আর টি এম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল, আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল নামে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে এসব এনজিও সেখানে কাজও শুরু করেছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ আরো অনেক এনজিও।

সূত্র জানায়, উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে ঠাসাঠাসির বসবাস ছেড়ে ভাসানচরে যেতে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা রাজি হয়েছে। তবে চার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।

নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়। তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের ভাসানচরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন।

ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অনেকে জানান, তারা ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে এবং প্রথম দপে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেয়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেখানে যেতে রাজি হয়েছেন। তাদের মতে পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলে মনে করছে রোহিঙ্গারা।

কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখে তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারায় আরও অনেক পরিবার সেখানে যেতে আগ্রহী হচ্ছে বলে মনে করছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক দায়িত্বশীল সূত্র।

রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দফে ভাসানচর যাত্রা নিয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভাসানচরের পথে চট্টগ্রাম থেকে চূড়ান্ত ভাবে জাহাজে না উঠা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের যাত্রা নিয়ে কোন কথা না বলার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রথমবার যেভাবে সময়মতো গণমাধ্যমকে সবকিছু জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, পরবর্তী ধাপেও একই ভাবে জানানো হবে। তখন দেশবাসী ও সারা বিশ্ব বিষয়টি জেনে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

Share.
Exit mobile version