আইবুড়ো। সুমাইয়া শাওলিন

অনার্স প্রায় শেষের দিকে । তখনো বিয়ে হয়নি আমার ।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভীষন কেঁদে , রীতিমত যুদ্ধ করে নিজের জন্য চারটে বছর সময় নিয়েছিলাম পরিবারের কাছ থেকে। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরেই বিয়েতে মত দেব এমন ভাবনাটা চারটে বছর আমাকে ঠিকঠাক বাঁচতে দেয়নি ।

তখন যা শুনতাম, “শুধুই শুনতাম” ঠিকাছে শুনে উড়িয়ে দেয়া যেত । কিন্তু এখন যা শুনছি , তা উড়িয়ে দিতে বড্ড ক্লান্তি ধরে যায় শরীরে । ভীষন লাগে যখন পাত্রপক্ষ বয়স বেশির কারণ দেখিয়ে বাবা মায়ের মনটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যায় ।
আরো ভীষন জোরে লাগে যখন বাবা একাকী কোথাও চুপ করে বসে আকাশ দেখে আর মা প্রতিবেশী, আত্মীয় -স্বজনের কাছ থেকে বিদঘুটে কথা শুনে একাকী কাঁদে অথচ আমাকে কিছুই জানতে দেয় না।

আমি কানপেতে সবটাই শুনি , না শোনার ভান করলেও আমার কানে আসে সবটাই। কখনো গা জ্বলে ওঠে, কখনো কান্না পায় আবার কখনো চুপসে যাই ভাবতে থাকি আসলেই কি অনেক দেরি হয়ে গেল আমার সিদ্ধান্ত নিতে ?
আর বুঝি বিয়েটাই হবেনা আমার ?
লোকে কি বলবে? আমার পরিবার আর কতো কথাই না শুনবে !
বাবা মা চিন্তায় অসুস্থই থাকে , ভাবতে থাকে “কি হবে আমার জীবনের” ? তাদের কিছু হলে কে দেখবে আমায় !
তবে কি ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরেই বিয়ে করাটা উচিত ছিল! কিন্তু আমার পড়ালেখাটাও যে দরকার ছিল !

মনে আছে সেদিনের কথা , মা বলেছিল “বিয়ের পরেও পড়া যায় ” !
আমি তখন মাকে বলেছিলাম, দেখোছো না ? মা , আমরা আট বান্ধুবী ছিলাম একসাথে , ছয় জনের বিয়ে হয়ে গেল , কারো বাচ্চাও আছে ফুটফুটে , চারজনের কি ভালো অবস্থা ! কই ওদের পড়াটা যে আর হলো না ! ওদের মধ্যে একজন পড়েছিল কিন্তু ঐ না পড়ার মতো, আরেকজন তো টেনেটুনে অর্ধেক পড়েই সংসারের টানে মাঝপথে ছেড়ে দিল ।
বিয়ের পরে পড়াবে বলে ওদের কাউকেই তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দিলো না । তুমি তো জানো মা সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম , ভেবেছিলাম যদি আমার অবস্থাটাও ওদের মতো হয় । এরপরেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম , গ্রাজুয়েট হয়েই বিয়ে করবো । তার আগে যদি হয় হলে হবে , তবে আমার ইচ্ছেতে বিয়েটা হবেনা ব্যস।

পেছনের ফেলে আসা কথাগুলো মনে পড়তেই জল উপচে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে ।
এখন আমি উচ্চ শিক্ষিত , ভালো চাকরীর সন্ধানে ছুটছি……
এইতো টিউশন করে চলছি সাথে হাতের টুকিটাকি কাজ দিয়েও চলে যাচ্ছে দিন ।
এদিকে দেখতে দেখতে যেমনই আমার বাবার মায়েরও বয়স এগোচ্ছে , তেমনই বাড়ছে জীবনে নানান জটিলতা ।
ওদিকে চারপাশের পরিস্থিতি যেমনই হোক , আমার অনুভব বলছে ” জীবন সুন্দর ” !
এখনো আমার অনেকটা পথ চলা বাকি ।

দিন যাচ্ছে !
এসবের মাঝেও বেশ মজার ব্যাপার হচ্ছে এখনো প্রায়ই পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে আমায়। ঘটক মশাই-ও হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা , যতটা ফুষিয়ে-ফাসিয়ে নেয়া যায় । ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের মতো দেখতে পাত্রটিও বলে যাচ্ছে আমি আরেকটু ফর্সা , আরেকটু কম বয়সি হলে ভালো হতো । কেউ কেউ তো যৌতুকের নামে মোটা সোটা উপহার চেয়ে বসছে । এভাবে আসছে আর যাচ্ছে ।
তারা চলে গেলে আমিও ওপাশ থেকে ঘটক চাচার মতো একগাল পান ঠুসিয়ে ফিক করে হেসে বলে ফেলি –
উহ্’ একেতো এসেছে উগান্ডার কাঁচকলা তার উপর চাইছে আমেরিকান সিটিজেন । আর ঐ যে আগেরবার যারা এসেছিল তারা তো ১৪ / ১৬ বছরের উচ্চশিক্ষিত পাত্রীই খুঁজেছিল ।
উফ মা তোমার মেয়ের কপাল খারাপ যে , ওমন দলের প্রার্থী সে নয় । তুমি কিন্তু একদম চাপ নেবে না বলে দিলাম ।

মা…. মা………ওমা শুনছো , কি হলো- শুনছো না ?
এবার এখান থেকেও আমার মনোনয়ন পত্রটা উঠিয়ে নাও , আর রক্তচোষা ঐ ঘটকটাকেও বলে দিও আমি জীবনভর আইবুড়ো হয়েই থাকবো , তবুও বিয়ে করবো না !

জীবনটা তো বড্ড ছোট মা! ঐ যে যাদের বিয়ে হয়না আবার বিয়ে হলেও বিয়েটা যাদের টিকেনি এমন তো অনেক আছে এই সংসারে ।
এমন অনেক আছে যারা বিয়ের আগেই সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে চিরতরে , তুমি ধরে নাও না মা তোমার মেয়েও চলে গেছে তাদের মতোন করে ।
নয়তো ধরে নাও তোমার মেয়েও একজন যোদ্ধা ,
এমন এক যোদ্ধা, যে যোদ্ধা একা বাঁচার লড়াই লড়ছে – লড়বে !

Share.
Exit mobile version