রাঙা প্রভাত  প্রতিবেদক।। সংক্রমণহীন এলাকা চিহ্নিত করে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় বিধি মেনে ধাপে ধাপে দেশের স্কুলগুলো খুলে দিতে হবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত স্কুল খোলার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২১ সমীক্ষা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে শিক্ষা ও সাক্ষরতা কার্যক্রম সম্পন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের প্রাতিষ্ঠানিক জোট গণসাক্ষরতা অভিযান। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গাইডলাইন অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন ও নিরাপদ শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করার সুপারিশও করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে অন্তত ২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি; বিশেষত করোনা মহামারী ও শিক্ষার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২১ সমীক্ষা’ অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনা মহামারী ও শিক্ষার সার্বিক অবস্থায় পরীক্ষা ছাড়া প্রমোশন চান না ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চান। ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে অংশ নেন। ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২১ সমীক্ষা’ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও এডুকেশন ওয়াচের সদস্য সচিব রাশেদা কে চৌধূরী। আরও যুক্ত ছিলেন এডুকেশন ওয়াচের প্রধান গবেষক ড. মনজুর আহমদ, গবেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ এবং আহ্বায়ক আহমদ মোশ্তাক রাজা চৌধুরী এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অধাপক ড. সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন প্রমুখ।
পরীক্ষা ছাড়া প্রমোশন চান না ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী

সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষকদের ৬২ শতাংশই মনে করেন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা দরকার। ১৫ শতাংশ শিক্ষকের মতে, করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যেসব বিষয় পড়ানো সম্ভব হয়নি, সেগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই চাইছে, যেসব বিষয় পড়ানো হয়নি, আগে সেগুলো পড়ানো হোক। আর প্রায় ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতে, নতুন পাঠ শুরু করা হোক, অপঠিত পাঠগুলো বিবেচনায় রেখে। ২০ শতাংশের অধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এর বিপরীতে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ তারা পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের বিপক্ষে। করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেসব বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। কারণ এর পক্ষে মত দিয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশের কম শিক্ষার্থী।
৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চায়
৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত ক্লাসে ফিরে আসতে চায়; ৭৬ শতাংশ অভিভাবক চান যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলে দেওয়া হোক। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭৩ শতাংশই স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে; একই মনোভাব ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তার। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সর্তকতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহার, পরস্পরের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা তথা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ৭৯.৭ শতাংশ শিক্ষক অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছেন বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে।
দূরশিক্ষণে অংশ নেয় মাত্র ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় (টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। ৩৭.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পরিবার বা অন্যদের নিকট থেকে সহায়তা পেয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। গ্রামীণ এলাকায় এ হার ৬৮.৯ শতাংশ। অনলাইন ক্লাস আকষর্ণীয় না হওয়ায় ১৬.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে না। ৯৯.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বাড়িতে নিজে নিজে পড়ালেখা করেছে।
বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৩ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে বিদ্যালয়গুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত করে নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৪৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসার আসন বিন্যাসের পরিবর্তন প্রয়োজন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আগে এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত করে নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ৫০ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসার আসন বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭৭.৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয়ের টয়লেটসহ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি করা দরকার।
অনুপস্থিতি বাড়তে পারে
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন অধিক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ড্রপ-আউট হতে পারে। ৮.৭ শতাংশ মনে করেন শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ফলে ড্রপ আউটের হার বাড়তে পারে।
সমীক্ষায় সুপারিশ
স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে সংক্রমণহীন এলাকা চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য প্রণয়নকৃত গাইডলাইন অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন ও নিরাপদ শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করা।
শিক্ষার ক্ষতি পুনরুদ্ধার
মহামারীর কারণে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তত ২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পর্যায়ের জন্য নমনীয় ও পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষক সহায়তা মহামারীর কারণে শিক্ষকদের মানসিক চাপ কমানো ও তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলা এবং শিক্ষা পুনরুদ্ধার বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষার ক্ষতি পুনরুদ্ধারের জন্য স্থানীয় অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে কেন্দ্রীয়ভাবে দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রতিটি উপজেলার শিক্ষার্থীসংখ্যা বিবেচনা করে আনুপাতিক হারে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। গৃহীত পরিকল্পনাগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন মনিটরিং-এর লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা প্রয়োজন

Share.
Exit mobile version