কামরুল হাসান সোহাগ:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস। বাংলাদেশে দল মতের উর্ধে তিনি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিক। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সময় ১টা ৪১ মিনিট। বঙ্গবন্ধুকে বহন করা বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। প্রিয় নেতাকে বরণ করতে আসা লক্ষ জনতার মুখে প্রতিধ্বনিত হয় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান। দেশ স্বাধীন হলে বর্বর পাকিস্তানিদের বন্দীদশা হতে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে দিন প্রথম তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখলেন, সেদিন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা, মাটি ও মানুষ, রক্ত ও লাশের স্তূপ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। অঝোরে কেঁদেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বিমান হতে নামার পরে তাকে ফুল আর অশ্রু দিয়ে বরণ করেছিন তাজউদ্দীন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। তখন তারা উভয় কাঁদতে থাকেন শিশুদের মতো । সে এক অপুর্ব দৃশ্য। যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাদের স্মিতিতে আজও সে দৃশ্য উজ্জ্বল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যুর মুখ হতে যখন সন্তান ফিরলেন, তখন একজন পিতা তো আর বসে থাকতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ভালোবাসা, মমতা আর অশ্রু নিয়ে আপন সন্তানকে এক নজর দেখতে ছুটে এসেছিলেন সেদিন। শেখ লুৎফর রহমান তার সন্তানকে গড়ে তুলেছিলেন আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে। ন্যায়ের পক্ষে থেকে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াতে সারাজীবন সন্তানকে সমর্থন দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। ছেলে বারবার নির্যাতিত হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। কিন্তু পিতা গর্ব করে বলেছেন, আমার ছেলে ন্যায়ের জন্য লড়াই করে জেলে গেছে। এমন পিতার সন্তান না হলে কী বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা হতে পারতেন?
আগত জনগনের ঢলে ভেসে যাচ্ছিল বিমানবন্দর। সেখান হতে লক্ষ মানুষ পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু আসলেন রেসকোর্স ময়দানে [বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান] বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দুহাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু কে সেদিন বারবার চোখ মুছতে দেখা যাচ্ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে কেঁদেছেন উপস্থিত লক্ষ জনতা। এরপর দরাজ কন্ঠে বললেন, ‘আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না।’
এ সময় বঙ্গবন্ধুর গলা বারবার আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। সুখ- দুঃখের মোহনায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিন, ‘আজ প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ, এত সাধারণ জনগণের মৃত্যু হয়নি, শহীদ হয়নি, যা আমার ৭ কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না, আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি শুধু একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেল, কোন আপত্তি নেই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিয়ো—এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।’
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার শুনছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামে পাশে থেকে বেগম মুজিব প্রেরণা যুগিয়েছেন আজীবন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’–তে সে আত্মত্যাগের কথা বারবার এসেছে।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাখাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বলেছেন, ‘৪ ডিসেম্বর (১৯৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সব বিচারককে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান রায় তৈরি করার জন্য। বিচারক মানে ওই সব কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার। তিনি তাদের বিচারের রায় জানিয়ে দেন। এবং সেখানেই তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নেয়।’
এরপর কারা কক্ষের পাশেই কবর খনন করা হয়। নিজেই দেখলেন নিজের কবর খোঁড়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভয় নেই, আমি তৈরি আছি।
পাক হানাদারদের বঙ্গবন্ধু শুধু একটা অনুরোধ করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর তার লাশটি যেন তার বাঙালির কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। ডেভিড ফ্রস্ট জানতে চাইলেন, ‘আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না আপনার স্ত্রী-পুত্র–পরিজনের কথা?’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু নিঃসংকোচে বলে দিলেন, ‘আমার প্রথম চিন্তা ছিল আমার দেশ, তারপর আমার পরিবার। আমি আমার জনগণকেই বেশি ভালোবাসি।
আজীবন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। একটিই সাধ বাংলাদেশের নিপিরিত জনগনের মুক্তি, স্বাধীনতা। আর তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে বুক চিরে বেরিয়ে আসা কথাগুলো এভাবে বললেন, ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, ‘আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে। আর তাই জন্মের শত বছর পরেও বঙ্গবন্ধু তার আদর্শে আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
Attachments area
Share.
Exit mobile version