বিশেষ প্রতিনিধি।। বিমানবন্দরেই তাদের ঘরবাড়ি। দেশে ফেরা প্রবাসীদের পাশাপাশি বেড়াতে আসা বিদেশি নাগরিকদের টার্গেট করে চক্রটি। নিজেকে হাজী পরিচয় দেয়া চক্রের মূল হোতা হাজী মাসুদুল হক ওরফে আপেলের নেতৃত্বে চলে ছিনতাই, ডাকাতি এবং লুটপাট। বিমানবন্দরে নামার পর প্রথমে প্রবাসীদের গাড়ি ভাড়া করে দেয়ার প্রস্তাব দেয় চক্রটি। এরপর তাদের নির্ধারিত গাড়িতে তুলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে, খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক মেশানোসহ বিভিন্নভাবে ছিনতাই এবং ডাকাতি করে থাকে। চক্রটি গত এক বছরে অর্ধশতাধিক প্রবাসীর প্রায় ৪০ লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করেছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা জালে আটক হওয়া চক্রের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতির ভয়ঙ্কর সব তথ্য জানিয়েছে।
মহানগর গোয়েন্দা তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৫ই অক্টোবর যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় আসেন ওমর শরীফ নামের প্রবাসী এক ব্যক্তি।

তার গ্রামের বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামে। তিনি বিমানবন্দর এলাকায় নামার পর মাসুদের চক্রের সদস্যরা প্রথমে তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। পরে ঢাকার বাইরের একটি জেলায় নিয়ে তার সঙ্গে থাকা পাসপোর্টসহ সব মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয় চক্রের সদস্যরা। এরপর রাস্তায় ফেলে যায় তাকে। মো. লিটন সরকার। পাঁচ বছর পর মিশর থেকে তুর্কি এয়ারলাইনসযোগে গত ৭ই সেপ্টেম্বর দেশে আসেন। প্রবাসী লিটন হযরত শাহ্‌ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে বিমানবন্দর গোল চত্বরে ফুটওভার ব্রিজের নিচে গিয়ে বাসার উদ্দেশে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় তার সঙ্গে কেউ ছিল না। হঠাৎ ওঁৎপেতে থাকা অজ্ঞাতনামা পাঁচ থেকে ছয়জন সদস্য ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে লিটনের সঙ্গে থাকা হ্যান্ডব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা তাকে ঘটনাস্থল থেকে একটি বাসে তুলে দেয়। এবং ছিনতাইয়ের বিষয়ে কাউকে কোনো কিছু না জানানোর জন্য ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়।
লিটন জানায়, তার ব্যাগে থাকা একটি পাসপোর্ট, মিশরের ভিসা, বিমানের টিকিট, স্বর্ণের চেইন, দু’টি মোবাইল ফোন, একটি স্মার্ট কার্ড, প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়সহ নগদ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এ ঘটনায় গত ১৫ই সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন তিনি। পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে মহানগর গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগ। পরবর্তীতে তথ্য- প্রযুক্তির সহায়তায় ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে হাজী মাসুদুল, আমির হোসেন ও শামীমকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানায়, করোনা সংক্রমণ কমার কারণে বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে আসতে শুরু করলে এটাকে উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে চক্রটি। মাসুদুলের ডাকাত দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কখনও ডাকাতি, কখনও ছিনতাই, কখনও অজ্ঞানপার্টির সদস্য হিসেবে তারা কাজ করে থাকেন। চক্রটি প্রথমে প্রাবসীদের টার্গেট করে। পরবর্তীতে টার্গেটকৃত প্রবাসীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার একপর্যায়ে তাদের চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে। এরপর তাদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, মোবাইল, পাসপোর্টসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে পালিয়ে যায়।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বিমানবন্দরকেন্দ্রিক এই চক্রটি গত একবছরে অর্ধশতাধিক ছিনতাই-ডাকাতি-অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। এবং মালামাল লুণ্ঠন করেছে। এসব ঘটনার বিপরীতে মামলা হয়েছে মাত্র সাতটি। ভুক্তভোগী অনেক প্রবাসীই মামলা করতে চান না। কারণ তাদের হাতে সময় কম থাকে। চার থেকে পাঁচ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ছুটি শেষে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার তাড়া থাকে। সব মিলিয়ে এ সকল প্রবাসীরা বাড়তি ঝামেলা এড়াতে মামলা করেন না। চক্রটির মূল হোতা মাসুদুলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এ বিষয়ে ডিবি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার মানবজমিনকে বলেন, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রথমে টার্গেট করে মাসুদুলের চক্রের সদস্যরা। তারা প্রবাসীদের কাছে নিজেদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে কখনো অস্ত্রের মুখে কখনো কৌশল অবলম্বন করে অচেতন করতে চা, কফি, জুস, ডাবের পানি ইত্যাদির সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যদের আটক করতে গোয়েন্দা অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

Share.
Exit mobile version