“পহেলা বৈশাখের পান্তা উৎসবে ইলিশ এলো কোত্থেকে?”

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন- পহেলা বৈশাখে পান্তার সাথে আপনার এক টুকরা ইলিশ খেতে গিয়ে সারাদেশে একদিনে কত লক্ষ টন ইলিশ মাছের ঘাটতি হচ্ছে? বাঙালিত্ব প্রমানের এই ইলিশ-পান্তার উৎসবকে ঘিরে মাত্র একদিনেই দেশের এই রূপালী সম্পদের কি পরিমান ক্ষতি হচ্ছে? শুধু দেশের ক্ষতি নয়, আপনার নিজের পকেটের টাকারও তো শ্রাদ্ধ হচ্ছে। নববর্ষের জন্য ইলিশ কিনতে গিয়ে অন্য সময়ের চেয়ে দিগুণ-তিনগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। তাহলে উপকার হচ্ছে কার? ইলিশ মাছের বাজারজাতকরণের সাথে যারা জড়িত সেই মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণী লাভবান হচ্ছে। উৎসবকে ঘিরে আপনার উন্মাদনার সুযোগ নিচ্ছে মূলত তারাই।

আপনার হাতে যে ইলিশ মাছটি এক হাজার টাকার বিনিময়ে এসেছে সেটার জন্য কত টাকা পেয়েছে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে সাগর ও নদীতে নামা সেই দরিদ্র জেলেটি? সে অন্য সময়ে যে দামে বিক্রি করে তার চেয়ে বড়জোর ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি পেয়েছে। কিন্তু আপনি কিনেছেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অন্তত তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি দামে। তাহলে নিজের ক্ষতি করে, দেশের জাতীয় সম্পদের ক্ষতি করে আমরা লাভবান করছি কাকে? পান্তাভাতের সাথে মরিচ পোড়া, এক টুকরো পেয়াঁজ বা বিভিন্ন প্রকার ভর্তাই হলো বাঙালির নববর্ষের আসল ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। সেখানে কোথাও ইলিশ মাছ বাধ্যতামূলক নয়। বাংলা সংস্কৃতির পাঁচশো বছরের অতীত ইতিহাস খুঁজে কোথাও ইলিশ মাছের নাম পাওয়া যায়নি। অথচ ইলিশ ছাড়া আজ আমাদের এই উৎসব অপূর্ণ! পান্তাভাতের সাথে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক ইলিশ যেন থাকতেই হবে!

চৈত্র-বৈশাখের এই সময়টা ইলিশ মাছের দ্বিতীয় প্রজনন মৌসুম। এসময় নদীতে প্রচুর পরিমান জাটকা (ইলিশের ছোট বাচ্চা) থাকে। অথচ পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৫ দিন আগে থেকেই শুরু হয় নির্বিচারে ইলিশ শিকারের মহোৎসব। বর্ষবরণের এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছর কত লক্ষ টন জাটকা-ইলিশ নিধন হচ্ছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং একই সাথে জাতীয় সম্পদও বটে। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত এই প্রাকৃতিক সম্পদটি অফুরন্ত নয়। সারাবছর ধরেই এই প্রাকৃতিক সম্পদটি আহরিত হয় নির্বিচারে। জাটকা আর ডিমওয়ালা মা ইলিশের ক্ষেত্রেও মানা হয় না কোন নিয়মনীতি। বিশেষ করে কোন উৎসব বা পার্বণ থাকলে তো কথাই নেই। অন্য মাছের মতো বাণিজ্যিকভাবে ইলিশের চাষ সম্ভব নয় বিধায় এর সংরক্ষণ করা একান্ত জরুরি। এখনই সচেতন হয়ে ইলিশ সংরক্ষণের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে শুধু বইয়ের পাতা আর ছবিতেই দেখা মিলবে রূপালী এই মাছের রাজাকে।

শুধু আইন ও জেলেদের জেল-জরিমানা দিয়ে ইলিশ নিধন বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এর সাথে দরিদ্র জেলেদের জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু যারা আমরা এই ইলিশের ক্রেতা এবং ভক্ষণকারী তারা তো ইচ্ছে করলেই একটু সচেতন হতে পারি। আমরা কেন ইলিশ মাছ কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাজারে ইলিশের সংকট সৃষ্টি করছি? কেন সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর জেল-জরিমানা উপেক্ষা করে জেলেদের ইলিশ শিকারের জন্য সাগর এবং নদ-নদীতে নামতে বাধ্য করছি? আসল অপরাধী তো আমরাই। আমরা কিনছি আর খাচ্ছি বলেই তারা নিজের জীবন বিপন্ন করে নদীতে নামছে। আইনের তোয়াক্কা না করে ঝুঁকি নিয়ে ইলিশ ধরছে। ইলিশ না পেয়ে মশারী জাল দিয়ে ধরছে জাটকা আর রেণুও। ইলিশের বংশ নির্বংশ করে দিচ্ছে।

ইলিশ ছাড়া কি পান্তা খাওয়া যায় না? ইলিশ ছাড়াও আমাদের বাঙালিত্ব প্রমাণের আরো অনেক অনুষঙ্গ রয়েছে। আজকে যারা অতি বাঙালি সাজার এই বৈশাখী উৎসবে বেসামাল হয়ে পান্তা ইলিশের উন্মাদনায় মত্ত রয়েছেন মাত্র ১০ দিন পরে তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় আজ বাংলা মাসের কত তারিখ, আমি নিশ্চিত সেই প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারবেন না। কয়েক মাস পরে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলা কী মাস চলছে, এমন প্রশ্নের উত্তর তারা ক্যালেন্ডার না দেখে দিতে পারবেন না। এমনকি বাংলা কত সন গেল এবং শুরু হলো সেটাই অনেকে বলতে পারবেন না। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের একটু হলেও ভেবে দেখা উচিত উৎসব পালনের নামে আমরা কী করছি? কীসের জন্য করছি? কেনই বা করছি?

পরিশেষে বলতে চাই, আমরা বাঙালি। বিভিন্ন দিবস এবং উৎসব পালন আমাদের অতীত ঐতিহ্য। উৎসব পালন আমরা অবশ্যই করব। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সেই উৎসব পালনের উন্মাদনায় যেন কোনভাবেই আমার নিজের বা অপরের ক্ষতি করে না ফেলি, দেশের কোনো ক্ষতি করে না ফেলি। লোক দেখানো হুজুগের বাঙালি হওয়া অতি সহজ কিন্তু বাংলাকে ভালোবাসা ততটা সহজ নয়। এজন্য বুকের ভেতর দেশপ্রেম থাকতে হয়। তাই হুজুগের বাঙালি না হয়ে আমরা যেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক বাঙালি হতে পারি। আমরা সেই বাঙালি চাই, যে বাঙালি বাংলার জন্য; বাংলাদেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে।

লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না,
সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকারকর্মী।
৩০ চৈত্র, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।

Share.
Exit mobile version