বিশেষ প্রতিনিধি।। পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর এলাকার বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে পানি ঢুকেছে।

সিলেটে বৃষ্টি কমলেও বাড়ছে নদীর পানি। জেলার বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দি হয়ে আছে কয়েক লাখ মানুষ। এর মধ্যে বিয়ানীবাজার উপজেলার সব ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বিশ্বনাথ উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে তিনটি ইউনিয়ন। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ৬০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিলেট মহানগর পুলিশের কোতায়ালি মডেল থানা, ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানেও ঢুকেছে পানি। তলিয়ে গেছে নগরের একমাত্র শ্মশানঘাট (চালিবন্দর এলাকায়)। এতে দাহকাজ ব্যাহত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ ও ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণের পানি এখন নিম্নাঞ্চলে চাপ সৃষ্টি করেছে। গতকাল বুধবার বিকেল ৩টায় সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৮ সেন্টিমিটার ও ছাতক পয়েন্টে বিপত্সীমার ১.৫৮ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সুনামগঞ্জ সদরের যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, সেসব এলাকার পানি নেমে গেছে। হঠাৎ বর্ষণ ও ঢলের পানিতে পৌনে দুই শ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। নিমজ্জিত হয়েছে ৭২০ হেক্টর জমির বোরো ধান। এতে বড় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এদিকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে নিমজ্জিত হওয়ায় জেলার ২৪৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান সাময়িক বন্ধ আছে। এর মধ্যে ২৮টি বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলায় সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমান এ তথ্য জানান।
জোয়ারের পানি ও শ্রমিকসংকটের কারণে ধান কাটতে না পেরে দিশাহারা হয়ে পড়েছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার চান্দার বিলসহ বড়বিল এলাকার প্রায় ১৫ হাজার কৃষক পরিবার। এমবিআর ক্যানেলের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় মাত্রাতিরিক্ত পানি বেড়ে তলিয়ে যেতে বসেছে চান্দার বিলের প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ‘বিল কুজাইন’ মাঠের প্রায় ৪০০ হেক্টর (তিন হাজার বিঘা) জমির পাকা ও বেশির ভাগই কেটে জমিতে রাখা ইরি-বোরো ধান পুনর্ভবা নদী হয়ে উজানে ভারত থেকে আসা বৃষ্টি-ঢলের পানিতে পাঁচ দিন ধরে নিমজ্জিত হয়ে আছে।

সিলেট জেলায় এক হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় ৪১৮টি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশেদ। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জেলার ৬০৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কলেজের মধ্যে ২২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। ’

গতকাল দুপুরে সুরমা নদীর তীরসংলগ্ন সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা এলাকায় পানি জমেছে। নগরের তালতলা এলাকায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয়ে সুরমার পানি ঢুকে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের (সদর) সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের একটি অংশ দক্ষিণ সুরমা স্টেশনে, আরেকটি অংশ নগরের রিকাবীবাজারে কাজী নজরুল অডিটরিয়ামে আশ্রয় নিয়েছে। এখান থেকেই আপাতত সব কাজ চালানো হবে। ’

নগর ঘুরে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, উপ মহাপুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়, সড়ক ও জনপথের তোপখানা কার্যালয়, সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুতের আঞ্চলিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
চালিবন্দরের শ্মশানঘাট সংস্কার ও সংরক্ষণ কমিটি, সিলেটের সভাপতি বেদানন্দ ভট্টাচার্য বলেন, ‘ধর্মাবলম্বী সবাইকে দেবপুরের শ্মশানঘাটে দাহকাজ করার অনুরোধ করছি। ’ সিলেট নগরে পানিবন্দি রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘আজকে সিলেট নগরে দু-একবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে নগরে পানি বেড়েছে। ’ বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিয়ানীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় গতকাল সকাল থেকে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। উপজেলায় ২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বিশ্বনাথ উপজেলায় সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের বিভিন্ন অংশসহ গ্রামীণ রাস্তা তলিয়ে গেছে। উপজেলায় ১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তত করা হয়েছে।

সুনামগঞ্জে ধান-মাছের ক্ষতি

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী-২ শামসুদ্দোহা বলেন, পাউবোর আবহাওয়া ও বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ আসাম, মেঘালয়ে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কার পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে নদ-নদীর পানি আবার বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। কৃষকরা জানিয়েছেন, জেলার হাওরের বাইরে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান নিমজ্জিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও ছাতক উপজেলার প্রায় ৬৭৫ হেক্টর জমির বোরো ধান নিমজ্জিত হয়েছে। ৭০ হেক্টর বাদাম ও ৫০ হেক্টর জমির সবজি নিমজ্জিত হয়েছে

Share.
Exit mobile version