ফয়সাল হোসাইন সনি, বগুড়া সংবাদদাতা।। বগুড়ায় সুদ কারবারি চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। জায়গা, জমি ও দোকান বিক্রি করে মানুষকে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। মানুষ সুদের টাকা নিয়ে সুদ দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেলেও এই কারবার করে রাতারাতি শূণ্য থেকে কোটিপতি বনে যাচ্ছে সুদ কারবারিরা। সুদের টাকা দিতে না পেরে কেউ কেউ হার্ট করে মারা যাচ্ছেন আবার কেউ আত্মহত্যাও করছেন এ রকম নজিরও রয়েছে বগুড়ায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শহরের উত্তর চেলোপাড়ার সান্দারপট্টি এলাকা হলো সুদ কারবারি চক্রের ‘হেড কোয়ার্টার’। বগুড়া জেলা জুড়ে গড়ে উঠেছে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক। সান্দারপট্টি থেকেই সুদের কোটি, কোটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। সেখানকার অর্ধ শতাধিক সুদ কারবারি সুদের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে। সান্দারপট্টির কয়েকজন নারী সুদ কারবারি চক্রের ‘খল নায়িকা’। প্রতিমাসে লাখ প্রতি তারা ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চড়া সুদ নিয়ে থাকে। সুদ নিয়ে সময় মত না দিতে পারলেই মহা বিপদ। টাকা গ্রহিতার ওপর নেমে আছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তাদের পিছনে লেলিয়ে দেয়া হয় ‘গৃহ পালিত’ সন্ত্রাসি বাহিনী। এই বাহিনী সুদ গৃহিতাকে বাড়ি বা দোকান থেকে তুলে নিয়ে আসে তাদের আস্তানায়। এরপর নিজেদের ‘টর্সার সেলে’ নির্যাতনের স্টীম রোলার চালিয়ে দেয় তাদের ওপর। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় না। ভয়ে সবাই চুপসে থাকে কারন টাকা গৃহিতারা তাদের কাছে জিম্মি। সুদের কারবারি চক্র টাকা দেয়ার সময় তাদের কাছ থেকে সই করা চেক, স্বাক্ষর করা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, জমি বা দোকানের দলিলপত্র নিয়ে রেখে দেয়। টাকা শোধ করতে না পারলে ব্যাংক চেকের পাতায় ইচ্ছামতো অঙ্ক বসিয়ে নেয়। তারপর মামলার ভয় দেখিয়ে চাপ দিতে থাকে। কোন কোন সুদের কারবারি আদালতে মামলা ঠুকে দেয়। প্রভাবশালী ও প্রচুর টাকার মালিক বনে যাওয়ায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না। আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন না তারা। উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে জায়গা, জমি ও দোকানপাট বিক্রি করে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হয় তাদের। এভাবে বগুড়া নিউ মার্কেটের তিনজন ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কেউ, কেউ দোকান বিক্রি করে সুদের টাকা শোধ করেছেন। আবার সুদের টাকা না দিতে পেরে হার্ট এট্যাক করে মারাও গেছেন। উল্লেখ্য, গত সোমবার ভোরে বগুড়া শহরের পুকুরপাড় নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ফোরকান জামান ফোরকান (৫৫) হার্ট এট্যাক করে মারা যান। তিনি ঋনগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। উত্তর চেলোপাড়ার সান্দারপট্টির এক নারী সুদ কারবারির কাছ থেকে সুদের ওপর কয়েক লাখ টাকা নিয়েছিলেন। সেই সুদ কারবারি তাকে চাপ দিয়ে আসছিল। এ কারনে তিনি হার্ট এট্যাক করে মারা যান বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, পুলিশও সুদ কারবারিদের সাথে পেরে উঠতে পারেনা। তারা পুলিশের ওপর হামলা করতে দ্বিধা করেনা। সুদের ৩৩ লাখ টাকা তুলে না দেয়ায় চলতি বছরের গত ১৭ এপ্রিল বিকেল ৫ টার দিকে রেখা, সূর্য, ডুলি ওরফে দুলি ও লাল্টু শেখ নামে উত্তর চেলোপাড়ার সান্দারপট্টির আলোচিত চার সুদের কারবারি বগুড়া সদর ফাঁড়িতে হানা দেয়। এ সময় তারা ফাঁড়ির এস.আই খোরশেদ আলমকে লাঞ্চিত করাসহ মারধোর করে এবং আসবাবপত্র ভাংচুর করে। পরে নারী পুলিশ এসে রেখা, সূর্য, ডুলিকে গ্রেফতার করে। তবে লাল্টু পালিয়ে যায়।

এস.আই খোরশেদ বলেন, রেখা, সূর্য, ডুলি ও লাল্টু শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার আফরুজা রাজ্জাক নামে এক নারীর কাছ থেকে ৩৩ লাখ টাকা পাওনা পায়। এই টাকা তুলার জন্য সেদিন ফাঁড়িতে তার কাছে আসে। তখন তিনি এ ব্যাপারে তাদের আদালতে শরন্নাপন্ন হতে বললে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সেইসাথে তারা হুমকি দেয় টাকা তুলে না দিলে তোর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করবো। কিন্তু তিনি আবারও তাদের আদালতে যেতে বললে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং তাকে লাঞ্চিত করাসহ মারধোর করে। এ ছাড়া তারা ফাড়ির আসবাব পত্র ভাংচুর করে। পরে নারী পুলিশ ডেকে এনে তাদের মধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এস.আই খোরশেদ আরও বলেন, আফরুজা রাজ্জাক তাকে জানিয়েছেন, তিনি তাদের কাছ থেকে ৩২ লাখ টাকা ধার নিয়ে সুদসহ ৫৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও তারা তার কাছ অতিরিক্ত সুদের টাকা দাবি কর আসছিল। এ দিকে, বগুড়া নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী রাব্বি পুলিশকে জানান, তার বন্ধু ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম ওই চক্রের আরেক নারী সদস্যের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু চারমাস পরে তাকে ৩০ লাখ টাকার সাথে আরও ১৭ লাখ টাকা সুদসহ মোট ৪৭ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। পরে জহুরুল ইসলাম বাড়ি ও জায়গা বিক্রি করে এই সুদে-আসলে তাকে শোধ করে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যান।

উল্লেখ্য, শুধু তারাই নন, এই সুদ কারবারি চক্রের কবলে পড়ে অনেক ব্যবসায়ীসহ সাধারন মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। দিন-দিন চেলোপাড়ার সান্দারপট্টিতে এই চক্রের কারবার বাড়লেও দেখার কেউ নেই। এ ব্যাপারে বগুড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, শুধু তার ওয়ার্ডের উত্তর চেলোপাড়ার সান্দারপট্টি কেন, সারাদেশেই সুদের টাকার কারবার চলছে। তিনি বলেন, সান্দারপট্টিতে ৩০ জনের মত সুদের টাকার কারবারি রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০জনই নারী। তারাই কোটি টাকার সুদের কারবার করে। তবে টাকা নেয়ার সময় কেউ তাকে জানায় না। যখন এই টাকার লেনদেন নিয়ে বিরোধ বাঁধে তখন তাকে জানানো হয়। তারপরও সুদের টাকার কারবার বন্ধ করতে তিনি উদ্যোগ নেবেন।

এদিকে, উত্তর চেলোপাড়ার সান্দার পট্টি ছাড়াও উত্তর চেলোপাড়া, বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুর, বাদুড়তলাস, বউ বাজার, ভাটকান্দি, নাটাইপাড়াসহ শহরের বিবিন্ন এলাকা, সোনাতলা, শিবগঞ্জ, ধুনট, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, কাহালু, আদমদিঘী, সারিয়াকান্দি, দুচাঁচিয়া, গাবতলীতে জমজমাট সুদের কারবার। সুদের চক্রে বন্দি এসব এলাকার কৃষকসহ সাধারন মানুষ।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বিপিএম বলেন, সুদ কারবারি চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে সুদ কারবারি তিন নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই কারবারি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করা হবে।

Share.
Exit mobile version