সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, নদনদীতে হাহাকার
সুস্বাদু লোকাল ইলিশের হদিস নেই * ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ৩০ হাজারের বেশি ট্রলার মাছ ধরতে গেছে সাগরে
বিশেষ প্রতিনিধি।।
নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে বিপুলসংখ্যক ইলিশ ধরা পড়ার খবর আসছে।সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, নদনদীতে হাহাকারষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে বিপুলসংখ্যক ইলিশ ধরা পড়ার খবর আসছে। কিন্তু নদ-নদীতে এ চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সুস্বাদু লোকাল ইলিশের কোনো দেখা নেই। অথচ বাজারে নদ-নদীর ইলিশের চাহিদাই বেশি। মোকামগুলোয় সাগরের ইলিশের সরবরাহ থাকলেও মৎস্য ব্যবসায়ীরা খুব একটা খুশি নন। কারণ লোকাল ইলিশের সরবরাহ না বাড়লে ব্যবসা হবে না।
বাংলাদেশ ফিশিং বোট মালিক ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ৩০ হাজারের বেশি ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে গেছে। শনিবার মধ্যরাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। এরপর ইলিশসহ অন্যসব মাছ ধরতে অগণিত ট্রলার সাগরে ছুটেছে।
রোববার বরগুনার পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে প্রায় দেড় কোটি টাকার ইলিশ বিকিকিনি হয়। বরিশালের ইলিশ মোকামেও একই চিত্র। এখানে আসা ইলিশের পরিমাণ প্রায় ৮শ মণ। এভাবে পটুয়াখালীর মহিপুর, ভোলার মনপুরা, চরফ্যাশনসহ বিভিন্ন ইলিশ মোকামে মিলেছে সাগরের বিপুল ইলিশ। অবশ্য এভাবে সাগরের ইলিশ আসা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পাথরঘাটার একজন মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, সাগরে সাধারণত দুই পদ্ধতিতে মাছ ধরা হয়। দিনে গিয়ে দিনেই মাছ ধরে ফিরে আসা এবং সাগরে ৭-১০ দিন অবস্থান করে মাছ ধরে তারপর নিয়ে আসা। প্রশ্ন হলো-শনিবার মধ্যরাতে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর রোববার গভীর রাতের আগে ট্রলারগুলোর সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফেরার কথা নয়। অথচ একদিনে পাথরঘাটা মোকামে কোটি টাকার ইলিশ বেচাকেনা হলো। বরিশাল ইলিশ মোকামের এক ব্যবসায়ী বলেন, পাথরঘাটার মতোই অবস্থা ছিল বরিশালে। এখানে রোববার ইলিশ এসেছে প্রায় ৮০০ মন। অথচ সাগরে মাছ ধরার পর বরিশালে আসতেও ৮-১০ ঘণ্টা লেগে যায়। মহিপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী দেলোয়ার মৃধা বলেন, আসলে এবার নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বহু ট্রলার সাগরে মাছ ধরেছে। অবশ্য সেসব ইলিশ গোপনে বিক্রি হয়েছে। শেষের দিকে এসে ৫-৭ দিন আগে সাগরে গিয়ে ইলিশ শিকার করা ট্রলারগুলোই রোববার সকালে মাছ নিয়ে ভিড়েছে মোকামে। পাথরঘাটার চরদোয়ানীর একজন ব্যবসায়ী বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরদিন রোববার শুধু লিটন মাঝির ট্রলারই ২২ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করেছে। এখন বুঝে নিন-অন্য ট্রলারগুলোও কী পরিমাণ ইলিশ বিক্রি করেছে। বিভিন্ন মোকামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্যের সত্যতা মেলে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার দ্বিতীয় দিন সোমবার। রোববার মোকামগুলোয় বিপুল ইলিশ এলেও সোমবার ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। বরিশাল মোকামের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, সোমবার মোকামে খুব বেশি হলে ৪০০ থেকে ৫০০ মন ইলিশ এসেছে। আমরাও জানতাম-এভাবেই আসবে। প্রথম দিন কীভাবে বেশি ইলিশ এসেছে তাও আমাদের অজানা নয়। সাগরে বিপুল ইলিশ ধরা পড়ার খবর শোনা যাচ্ছে-এখন পর্যন্ত বরিশালে আমদানি কেমন জানতে চাইলে জহির সিকদার বলেন, এ মোকামে যেদিন দুই থেকে আড়াই হাজার মন ইলিশ আসে সেদিনই আমরা কেবল বলতে পারি যে ইলিশ এসেছে। মোকামের বাণিজ্য আর সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে হিসাবটা করি আমরা। আজকাল কিছু মিডিয়ায় দেখি ২০০-৪০০ মন ইলিশ এলেই প্রচার করা হয়-মোকাম ইলিশে সয়লাব হয়ে গেছে। কিন্তু এটা তো ঠিক নয়। এতে করে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
মোকামগুলোয় সাগরের ইলিশ এলেও লোকাল ইলিশের হাহাকার চলছে। অভ্যন্তর ভাগের নদ-নদীতে ধরা পড়া লোকাল ইলিশের চাহিদাই বাজারে সবচেয়ে বেশি। কেননা স্বাদ ও মানে এ ইলিশ সব দিক দিয়ে অনন্য। বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী-সোমবার বরিশাল মোকামে সব মিলিয়ে ৫০ মনেরও কম লোকাল ইলিশ এসেছে। সরবরাহ না থাকায় এ ইলিশের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। বরিশাল মোকামে এক কেজি সাইজের লোকাল ইলিশ ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকা মন দরে বিক্রি হয়েছে। মোকামের ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সাহা বলেন, মূলত লোকাল ইলিশের সরবরাহের ওপরই নির্ভর করে ইলিশ ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা। স্থানীয় নদ-নদী থেকে ধরা পড়া এ ইলিশের চাহিদা দেশজুড়ে। কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে লোকাল ইলিশ মিলছে না বললেই চলে। সরবরাহ বেশি হলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে লোকাল ইলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাগর থেকে আসা ইলিশের চাহিদা খুব একটি বেশি না থাকায় এর দামও কম। সোমবার মোকামে সাগরের ইলিশের পাইকারি দর ছিল মনপ্রতি ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকা। এছাড়া সাগরের ইলিশের সাইজ আলাদা করা হয় না। ট্রলার থেকে নামানোর পর গড় হিসাবে ধরা হয়। এ ইলিশ স্থানীয় বাজারেও খুব একটা যায় না। ট্রলার থেকে নামিয়ে ওজন করে প্যাকিংয়ের পর সরাসরি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের পরিচালক হাসান আবিদুর রেজা বলেন, প্রকৃতিতে এখন ইলিশের মৌসুম চলছে। ৬৫ দিন বন্ধ থাকার পর সাগরে মাছ শিকার করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, হিসাব অনুযায়ী এখন দেশের অভ্যন্তর ভাগের নদ-নদীতে ইলিশ থাকার কথা। তবে হতাশার কিছু নেই। মৌসুম শেষ হতে যেহেতু এখনো বাকি তাই ইলিশ যে ধরা পড়বে না এমন নয়। এছাড়া এখন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ইলিশ উৎপাদন। হয়তো ২-৪ দিনের মধ্যেই জেলেদের জাল ভরে উঠবে নদ-নদীর লোকাল ইলিশে।