ইব্রাহীম রুবেল।।
চলতি বছরের ২৭ মে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে, পাঠাওয়ে রয়েছে প্রায় ২ লাখ চালক ও বাহন। আর উবারে আছে ১ লাখের বেশি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সম্প্রতি বলেছে, পোশাকশিল্পে ২১ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৭৯ এবং পুরুষ নয় লাখ ১৬ হাজার ১৮২ জন। রানা প্লাজা ধসের পর এক বছর ধরে সারা দেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে।
অধিদপ্তরের শ্রমিকদের যোগ করলে পোশাকশিল্পে কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭২৫। এটি বিজিএমইএর দাবি করা শ্রমিকের সংখ্যার চেয়ে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ লাখ কম।
দেশের রপ্তানি আয়কে বছরের পর বছর প্রায় এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। আর এ খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, গত তিন বছর ধরে এমন দাবিই করে আসছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ আবার শ্রমিকসংখ্যা ৪২ লাখ বলেও দাবি করেন। যদিও এসব দাবির পেছনে কখনোই কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি তাঁরা।
ঢাকার এসব রিকশার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ২৭ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে বলে গবেষণায় জানা যায়। অবশ্যই এই হিসেব ২০১৯ সালের। তবে অন্য এক সমীক্ষায় ধারনা করা হয়েছে এখন প্রায় ১৫ লাখের অধিক রিক্সা শুধুমাত্র ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে এবং এই বাহনকে কেন্দ্র করে ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসেব অনুযায়ী তাদের সংগঠনের রেজিস্টার্ড ৫০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এর বাইরে আরো ২০ লাখ শ্রমিক রয়েছে রয়েছে বলে ফেডারেশন বলছে।
বাংলাদেশে কি পরিমাণ ছেলেমেয়ে শিশু গৃহশ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আইএলও’র সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জাতীয় শিশু শ্রমিক জরিপের তথ্যে জানা যায়, দেশে ৭৪ লাখ ২০ হাজার শিশু বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, যার মধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা ১৯ লাখ ২০ হাজার। এদের ১ লাখ ১ হাজার ৬৭৬ জন শিশু গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন শৈশব-বাংলাদেশ পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই ৩ লাখ শিশু গৃহ শ্রমিকের কাজ করে। যার ৮০ ভাগ হচ্ছে মেয়েশিশু, বাকি ২০ শতাংশ ছেলেশিশু। যাদের বয়স ৯-১৬ বছরের মধ্যে। আবার ঢাকা শহরে গৃহপরিচারিকা বা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ লাখ ২৫ হাজার। এ তথ্যও অবশ্য আট থেকে দশ বছরের পুরনো।
তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাপোর্ট স্টাফ গণ, ভ্যান চালক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্যের অর্ডার গ্রহণকারী কর্মীগণ, ডেলিভারিম্যান, কারখানা শ্রমিক, হকার, মিস্ত্রি, কুলি, ঠেলাওয়ালা, চাওয়ালা, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজুর,শো-রুম বা দোকান কর্মচারী, সিকিউরিটি সার্ভিসের কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিবর্গ, গ্যারেজের শ্রমিক, হোটেল বয়, বাদামওয়ালা, সবজি বিক্রেতা,খুদে দোকানদার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, দৈনিক ভিত্তিক ছুটা শ্রমিক ।
অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন এখনো শুরুই হচ্ছে ১৫-১৮ হাজার টাকায়। এবং বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও বেতন বাড়ানোর নামগন্ধ থাকে না বা বৃদ্ধি পেলেও অতিনগন্য।
করোনার কারণে আগের কর্মসংস্থান যেমন অনেকে ধরে রাখতে পারেননি, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এতে শ্রমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হয়নি বললেই চলে। উলটো চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। সরকারি খাতেও খুবই কম চাকরির সংস্থান হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ২৬ থেকে ২৭ লাখ লোক নতুন করে শ্রমের বাজারে আসে।
এ হিসাবে দুই বছরে এসেছে ৫২ থেকে ৫৪ লাখ লোক। এদের বেশিরভাগেরই কর্মসংস্থান হয়নি। আইএলওর হিসাবে আগে সাড়ে ৩ কোটি লোক বেকার ছিল। সব মিলে এখন বেকারের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪ কোটি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি চাকরি ১৪ দশমিক ২ শতাংশ, অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ২১ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ, আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজন বেকার। এ মুহূর্তে ১৮-২৮ বছর বয়সি যে সংখ্যক যুবক আছেন, তাদের তিনজনে একজন বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার কম।
তাছাড়া রয়েছে বিদেশ ফেরত কর্মীগণ যারা নানবিধ জটিলতায় আর কাজে ফিরে যেতে পারেন নাই।
তাছাড়া গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়াশুনা করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের জীবন একই ধারায় গননা করা যায়। অবিভাবকদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং টিউশন থেকে প্রাপ্ত উপার্জনে হিসেব করে সব খরচের পরিকল্পনা করতে হয়।
এসবের বাইরেও সরকারের বিভিন্ন শাখার তথ্য অনুযায়ী দেশে আড়াই লাখ ভিক্ষুক রয়েছে বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ।
এইসব তথ্য উপাত্ত বা পরিসংখ্যানের বাইরেও নানা ছোটখাটো পেশায় জড়িতরা তো রয়েছেনই।
কতোটা বেড়েছে এদের বেতন কিংবা উপার্জন? তাদের জীবনযাপনের বাজেট আসলে কি? কে ভাবছে তাদের বিষয়ে? আমরা শুধু ভাবছি তেল বিক্রিতে বিপিসির লোকসান।
বৈশ্বিক মহামারী এবং যুদ্ধাবস্থায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এইসব মানুষজন দুইবেলা একবেলা খেয়ে হয়তো মানিয়ে নিচ্ছিল তবে জ্বালানী তেলের এত বিশাল পরিমান মূল্য বৃদ্ধির এই ধাক্কায় জীবনযাপন কি হবে ? হয়ত ভাবতেই স্তব্ধ হয়ে যাবে ব্রেইন যন্ত্র।
উপরের প্রতিবেদন বিবিসি বাংলা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তর এর প্রতিবেদন এবং নানাবিধ তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।