বাস্তবতার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি
আমাকে কুমিরে ধরেছিল
বিশেষ প্রতিনিধি।।
নদীতে গোসল করতে নেমে কুমিরের খপ্পরে পড়েছিলেন রাজু হাওলাদার। পানির নিচে অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি আর সাহসের জোরে বেঁচে ফিরেছেন। রাজুর কাছে রুদ্ধশ্বাস সেই মুহূর্তের গল্প শুনালেন তিনি।
সুন্দরবনের পাশে ঢাংমারী নদী, অন্য পাশে আমাদের গ্রাম। এই নদীর জলেই আমাদের বেড়ে ওঠা। গ্রামের নামটাও নদীর নামেই—ঢাংমারী। বনের প্রতিবেশী নদীটি প্রায় ৩০০ হাত প্রশস্ত।
আমাদের ঘর থেকে ঘাটের দূরত্ব ২০ কি ২৫ হাত হবে। নোনাজলের ঢাংমারীর পানি এখন কিছুটা মিষ্টি; বরং পুকুরের পানি সেই তুলনায় বেশি লবণাক্ত। মাঝেমধ্যে তাই নদীতে গোসল করতে যাই। এলাকার অনেক মানুষই করে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাঁচকা টানে পানির তলে চলে যাই। তলদেশ ঘেঁষে আমাকে গভীরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে
ঢাংমারী নদীর এই অংশে নেমে কুমিরের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন রাজু হাওলাদার
ঢাংমারী নদীর এই অংশে নেমে কুমিরের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন রাজু হাওলাদার।
৮ আগস্ট বেলা দুইটা বাজে তখন। প্রচণ্ড গরম। গোসল করব ভেবে ঘর থেকে একটি মিনিপ্যাক শ্যাম্পু নিয়ে বের হই। নদীর পাড়ে শ্যাম্পুর প্যাকেটটা রেখে পানিতে নেমে পড়ি। বুকপানিতে নেমে একটা ডুব দিয়েই পাড়ে উঠে আসি। মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে ঘষতে ঘষতে আবার পানিতে নেমে পড়ি। বুকপানিতে গিয়ে শ্যাম্পু করতে থাকি। আচমকা ডান ঊরুতে কোনো একটি প্রাণীর কামড় অনুভব করি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাঁচকা টানে পানির তলে চলে যাই। তলদেশ ঘেঁষে আমাকে গভীরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। নদী ও বনের পাশে বড় হয়েছি। বাঘ-কুমিরের কত গল্পই শোনা। আমাকে যে কুমিরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে বাকি থাকে না। সেই সঙ্গে মনে পড়ে কুমিরের মুখ থেকে বেঁচে ফেরার একমাত্র উপায়ও। কত শুনেছি, কুমিরকে আঘাত করে কোনো লাভ হয় না, ওর মুখ থেকে ছুটে আসার একমাত্র উপায় চোখে আঘাত করা।
ডান ঊরু কামড়ে ধরে আমাকে তখন আরও গভীরে টেনে নিয়ে চলেছে কুমির। কুমিরের লেজের দিকে আমার মাথা। মাটির নাগাল পাওয়ায় বাঁ পায়ে জোর পাই, অমনি কোমরটা ঘুরিয়ে দুহাত দিয়ে কুমিরের চোখে আঘাত করি। আঘাত কতটা জোরালো ছিল, মৃত্যুর মুখে পড়া একজন মানুষই শুধু তা বুঝতে পারবে। আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গেই কামড় আলগা করে কুমির। হাত চালিয়ে পানির ওপরে ভেসে উঠি। মাথা তুলে দেখি, পাড় থেকে ১৫ থেকে ২০ হাত দূরে চলে এসেছি। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে করতে পাড়ের দিকে যাই। সাঁতরে যখন ঘাটে পৌঁছাই, গায়ে তখন একরত্তি শক্তি নেই। কাদার মধ্যে কোনো রকম হাছড়েপাছড়ে ওপরে উঠি।
চিৎকার শুনে ততক্ষণে বাড়ি থেকে বাবা, মেজ ভাইসহ প্রতিবেশী কয়েকজন চলে আসেন। আমাকে ধরাধরি করে ওপরে তোলেন তাঁরা। তখন দেখা যায়, ঊরুতে কুমিরের কয়েকটা দাঁত বসে গেছে। ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত পড়ছে। সবাই ধরাধরি করে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান। ক্ষতস্থানে ফিটকিরি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করেন। পরে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। ক্ষতটা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দেন তিনি। বর্তমানে ওই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রেই চিকিৎসা চলছে।
পরে শুনেছি, ভেসে ওঠার পর কুমিরটিও আমার পিছু নিয়েছিল। ঘাটের কাছে এসে শরীরও ভাসিয়েছিল। কুমিরকে ঘাটের কাছে ভেসে থাকতে দেখে উপস্থিত সবাই যা বোঝার বুঝে যায়। তাঁদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কুমিরটি পরে ডুব দিয়ে চলে যায়।
সবকিছু সেদিন মুহূর্তের মধ্যে ঘটেছে। সে কথা মনে পড়লে এখনো ভয়ে শিউরে উঠি। আশৈশব চেনা এই নদীতে কখনো কাউকে কুমিরে ধরেছে, এমনটা শুনিনি। আমার কপালেই কিনা সেটা ঘটল। গত কয়েক দিন ভয়ে নদীতে কেউ নামছে না।