বিশেষ প্রতিনিধি।। পাবনার তাঁত এলাকায় আগের মতো খট খট শব্দ নেই। এখন ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক তাঁত কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাঁতিরা কারখানায় উৎপাদন সচল রাখতে অনেকেই ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করছেন। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় লুঙ্গি- গামছা তৈরিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। সে তুলনায় পণ্যের দাম না পাওয়ায় কারখানা সচল রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে বেকার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। তাদের মলিন মুখে ক্ষোভ ও হতাশার ছাপ ।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া বেসিক সেন্টারের লিঁয়াজো অফিসার বাসুদেব দাস রাঙা প্রভাতকে বললেন, এখন জেলায় চালু হস্তচালিত তাঁত এবং বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো। বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে সুতা তৈরি, রং দেয়া, সুতা শুকানো, নলিভরা ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে গড়ে ৩-৪ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৩ লাখ মালিক-শ্রমিক পরিবারের ১৩ লাখ নারী পুরুষের জীবন-জীবিকা।

পাবনার এক তাঁত কারখানা মালিক সৈয়দ আলী বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। কিন্তু সরকার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ৪ থেকে ৫ ঘন্টা জেনারেটর চালু রাখলে ১০ থেকে ১২ লিটার তেল প্রয়োজন হচ্ছে। এই কয়েক ঘন্টার জন্য অতিরিক্ত দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রহম আলী, আব্দুল কদ্দুস ও আব্দুল জব্বার বলেন, আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন-চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ও রাতে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে। এ কারণে ঠিক মতো কাজ হচ্ছে না। আয়ও কমেছে, সংসার চালাতে সমস্যা হচ্ছে।

বেড়া উপজেলার তাঁতি আবুল হোসেন বলেন, জেলায় বারবার লোডশেডিং হওয়ায় এবং একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা এখন বন্ধ হতে চলেছে। যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, লোডশেডিংয়ের কারণে বর্তমানে সেখানে তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। এতে উৎপাদন কম হচ্ছে।

সুজানগর উপজেলার লুঙ্গি তৈরির শ্রমিক আবুল কাশেম জানান, আগে দিনে পাঁচ-ছয়টি তৈরি করা যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে এখন সারা দিনে তিনটি লুঙ্গি তৈরি করা যায় না।

পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১এর জেনেরাল ম্যানেজার মো. আকমল হোসেন বলেন, তার এলাকায় দিনের বেলায় প্রয়োজন হয় ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ মেগাওয়াট। এ ছাড়া রাতে প্রয়োজন হয় ৮২ থেকে ৮৩ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৬ মেগাওয়াট। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২এর জেনেরাল ম্যানেজার মো.মজিবুল হক বললেন, তার এরিয়ায় দিনের বেলায় প্রয়োজন হয় ৬০মেগাওয়াট।পান ৫২ থেকে ৫৪মেগাওয়াট।রাতে দরকার হয় ৯০ মেগাওয়াট।পাওয়া যায় ৭০ থেকে ৭১ মেগাওয়াট। ফলে স্বাভাবিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনার আতাইকুলা হাট গড়ে উঠেছে। হাটে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংক, কাপড় ব্যবসায়ী ও কারখানা মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আতাইকুলা হাটে প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে এসে শাড়ী, লুঙ্গি ক্রয় করে থাকেন। ভারতের ব্যবসায়ীরা এসব হাট থেকে শাড়ী ও লুঙ্গি কিনে থাকেন। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ মোটা টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রফতানি ও ব্যাংক লেনদেন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।

পাবনা জেলা তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি কামরুল আনান রিপন বলেন, লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় অধিকাংশ সময় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে দ্রুত সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

Share.
Exit mobile version