✪______আহমেদ মুন্না।

হিন্দুর ব্যথায় যে কাঁদে সে হিন্দু, মুসলিমের ব্যথায় যে কাঁদে সে মুসলিম, কিন্তু উভয়ের ব্যথায় যে কাঁদে সে মানুষ। ভারত কিংবা পাকিস্তান, বোমা যেখানেই পড়ুক মরবে তো মানুষই! যুদ্ধ কখনো সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধে থাকে শুধু ধ্বংস আর মৃত্যুর বিভীষিকা। ভারত-পাকিস্তানের প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের এই যুদ্ধ দিয়ে তাদের কিছুই অর্জন হবে না। জম্মু-কাশ্মীর সমস্যারও সমাধান হবে না। মাঝখান থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট হবে। একটা বেহুদা, অনর্থক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভয়াবহ পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান।

আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি চলমান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের কিছু নির্বোধ, দলকানা দালালদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে! বাংলাদেশে একটা বিশেষ দলের সমর্থক অনেক ভারতীয় দালাল আছে। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানের মানুষ মরলে তারা ভীষণ উৎফুল্ল হয়। আবার আরেকটা বিশেষ দলের সমর্থক অনেক পাকিস্তানি দালাল আছে। পাকিস্তানের হামলায় ভারতের নাগরিক নিহত হলে তারাও চরম আনন্দ পায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এদেশে প্রচুর ভারতীয় দালাল আছে, অনেক পাকিস্তানি দালালও আছে। কিন্তু বাংলাদেশি দালাল নাই। মানবতার দালাল নাই। যাদের কাছে নিজের দেশ এবং নিজের দেশের স্বার্থ সবার উপরে থাকবে। মানুষ এবং মানবতার জয়গান থাকবে সবার উপরে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এখন প্রাথমিক পর্যায়ে হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই যুদ্ধ সত্যিকারভাবে শুরু হলে তা চলবে দীর্ঘমেয়াদে। সেই যুদ্ধে কোনোভাবে চীন জড়িয়ে পড়লে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হওয়া বিচিত্র নয়। ভারত এবং পাকিস্তানের অহেতুক এই ইগোর যুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এদেশের অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়বে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাল দেখা দেবে। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ভৌগলিক কারণেই এই যুদ্ধে “বলির পাঠা” হবে বাংলাদেশ। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। দেশের তিনদিকেই ভারতের সীমানা। আরেকদিকে বঙ্গোপসাগর। যুদ্ধ শুরু হলে সকল বর্ডার সিল করে দেবে ভারত। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। ভারত তাদের সীমান্ত অঞ্চলের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিবেচনায় বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য পুশইন করাবে। যুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ নিলে দলে দলে ভারতীয় নাগরিকরা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে। এমনিতেই ২০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে বাংলাদেশ।

ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দুই পরাশক্তির দেশ। যুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ নিলে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে তারা দ্বিধা করবে না। একটা বোতাম টিপে দিলেই সব শেষ। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় হাজার হাজার মাইলের সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কোটি কোটি টন বোমার বিস্ফোরণে বিষাক্ত হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ-বাতাস। অক্সিজেনের পরিবর্তে বাতাসে ভেসে বেড়াবে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস। অজ্ঞাত রোগ এবং শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে গণহারে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হবে। জলবায়ু সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যাবে। ভূমন্ডলের উষ্ণতা মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পাবে। ওজোনস্তর ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্ষেতে কোনো ফসল হবে না। অনাবৃষ্টিতে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হবে। কিংবা অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে যাবে সমগ্র দেশ। খাদ্য সংকটে ১৯৭৪ সালের চেয়েও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে বাংলাদেশে। এগুলো সবই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য আসন্ন সম্ভাব্য পরিনতি।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এমনকি ভৌগোলিক কারণে যুদ্ধরত ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ক্ষতি হবে বাংলাদেশের। এই যুদ্ধে আমাদের দেশের অবকাঠামো ধ্বংস না হলেও অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কোথাও অবকাঠামো ধ্বংস হলেও অর্থনীতি মজবুত থাকলে তা পুননির্মাণ করা যায়। কিন্তু অর্থনীতি ধ্বংস হলে একটা দেশের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই বেহুদা যুদ্ধ একদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস করবে এবং আরেকদিকে আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিবেশ সম্পূর্ণ নষ্ট করবে। এমনিতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের খেসারত দিচ্ছে সমগ্র বিশ্ব। একটা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়েছে সেটা কাটাতেই আরও ২০ বছর লাগবে। এর উপরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে সেটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য হবে অর্থনৈতিক মৃত্যুর কারণ।

যেসব নির্বোধ গণ্ডমূর্খ প্রতিবেশি দুই দেশের অন্ধ সমর্থকরা ভারত-পাকিস্তানের হামলা-পাল্টা হামলায় হাততালি দিচ্ছেন তারা বুঝতে পারছেন না এই যুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ নিলে তা বাংলাদেশের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিনতি ডেকে আনতে পারে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন, এই যুদ্ধ যেন কিছুতেই স্থায়ী না হয়। যেন উত্তেজনার মধ্য দিয়েই শেষ হয়। কিংবা তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্ততায় যেন যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল লরিয়েট। তাকে বাংলাদেশি জনগণ মূল্যায়ন না করলেও সারাবিশ্বের কাছে তিনি ভীষণ জনপ্রিয় ও সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য একজন বাঙালি। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে তেমন পছন্দ করি না, কিন্তু সত্য স্বীকার করতেই হবে। এই মুহূর্তে বিশ্বে তার চেয়ে গ্রহণযোগ্য দ্বিতীয় কোনো বাঙালি নাই।

সুতরাং, তিনি চাইলে এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারেন। নিজের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বনেতাদের সমর্থন আদায় করে ভারত এবং পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। প্রয়োজনে নিজেই মধ্যস্থতাকারী হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সাথে আলোচনায় বসতে পারেন। যুদ্ধ বন্ধে ভারত-পাকিস্তানকে চাপ প্রয়োগের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় দেশের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও তৎপরতা চালাতে পারেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করে দারিদ্র্য বিমোচনের ফর্মূলা আবিস্কারের মাধ্যমে সারাবিশ্বের কাছে রোল মডেল হয়েছেন। অর্থনীতিতে তার নোবেল পদক জেতা যৌক্তিক এবং ভীষণ প্রাসঙ্গিক হলেও তিনি জিতেছিলেন শান্তিতে নোবেল। বিশ্বের কোথাও উল্লেখযোগ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা না করেও তার শান্তিতে নোবেল পদক পাওয়া নিয়ে বাঙালিদের মাঝে বিতর্ক থাকলেও এবার সম্ভবত সেই বিতর্ক অবসানের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তার হাতে। আমার মনে হয়, শান্তির নোবেলের প্রতি সুবিচার করার এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় তার হাতে আর আসবে না। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে সফল হলে তিনি আবার হতে পারেন বিশ্বের জীবন্ত কিংবদন্তি এক প্রবাদপুরুষ এবং বাংলাদেশকেও বাঁচিয়ে দিতে পারেন অনাগত এক মহাবিপর্যয়ের মহাবিপদ থেকে। #

Share.
Exit mobile version