✪ নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ক্লাসরুমসহ কলেজে মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাড়িতে প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে ব্যবহার করতে পারবে শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখবেন অভিভাবকরা। শিক্ষার মানোন্নয়নে এমন এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অভিভাবকরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছেন অঙ্গীকার। বৃহস্পতিবার দিনভর বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সরকারি আবুল কালাম কলেজে অনুষ্ঠিত অভিভাবক সমাবেশে উন্মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে নেওয়া হয় এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। সমাবেশে উপস্থিত শিক্ষার্থী অভিভাবকদের প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের ভয়াবহ মোবাইল আসক্তির কথা তুলে ধরে ফোন নিষিদ্ধের দাবি জানান। এদিকে এমন সিদ্ধান্তকে অনন্য ও অনুকরণীয় বলছেন উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ।
সরকারি আবুল কালাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শামীম আহসান খানের সভাপতিত্বে কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অভিভাবক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সহকারী অধ্যাপক নুরুন্নবী রাসেল, সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, সহকারী অধ্যাপক পরিমল কান্তি সিকদার, সহকারী অধ্যাপক আলী হোসেন, সহকারী অধ্যাপক আল আমিন হোসেন, প্রভাষক মাহবুব আলম, প্রভাষক জহিরুল হক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটির উপজেলা সম্পাদক আরিফ আহমেদ মুন্না, ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন হেমায়েত প্রমুখ। সমাবেশে বক্তব্য দেওয়া ১১ জন শিক্ষার্থী অভিভাবক নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের সন্তানদের মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি বন্ধে ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবি তোলেন।
শিক্ষার্থী নাদিয়া আক্তারের (ছদ্মনাম) মা নার্গিস আক্তার জানান, তার মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ায় আগে ভালো থাকলেও সে এখন সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। বাড়িতে তার মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করা হলে সে কলেজে এসে অন্য বান্ধবীর মোবাইলে নিজের ফেসবুক আইডি লগইন করে চালাচ্ছে। আগে সে ঠিকমতো ক্লাসে যেতে না চাইলেও এখন সে ফোন চালানোর জন্য নিয়মিত কলেজে যাচ্ছে।
অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশামনির (ছদ্মনাম) মা লাইজু বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টর সহপাঠীদের সাথে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছে। তারা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যোগাযোগ করে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীরা সবাই নদীর পাড়ে ঘুরতে যায়। কলেজ টাইমে একদিন গিয়ে দেখি সে ক্লাসে নাই। পরে ১০-১২ জনকে নদীর পাড় থেকে খুঁজে বের করি। অথচ কলেজে তখন তাদের ক্লাস চলছিল।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হানের (ছদ্মনাম) বাবা কবির হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে মোবাইলে ভয়াবহ রকমের আসক্ত। মোবাইল ব্যবহার করতে না দিলে সে আত্মহত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। পরে শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ে তাকে বাড়িতে মোবাইল চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কলেজে এসে সে পুরোটা সময় ফোন চালাচ্ছে। তাই কলেজের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানাই।
কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুরুন্নবী রাসেল বলেন, ‘এখন শিক্ষার্থীরা একদম পড়াশোনা করতে চায় না। সারাক্ষণ ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব এসব নিয়ে থাকে। তাদের পড়াশোনার মান দিনদিন খারাপ হচ্ছে। এ হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য করণীয় সম্পর্কে সকলের মতামত জানতে অভিভাবক সমাবেশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে অভিভাবকরা কলেজ চলাকালীন সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। বাড়িতেও তারা এটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করার জন্য অঙ্গীকার করেছেন।’
সরকারি আবুল কালাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শামীম আহসান খান বলেন, ‘দেশে সামাজিক অবক্ষয় এবং শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের সর্বশেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছি আমরা। এখনই ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। তাই শিক্ষক এবং অভিভাবকদের জবাবদিহিতার জায়গা নিশ্চিত করতেই কলেজে অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে সবাইকে ডাকা হয়েছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে ক্লাসরুম ও কলেজে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ, নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা চালু এবং প্রগ্রেস রিপোর্টসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে একযোগে কাজ করা ছাড়া এই বিপর্যয়ের থেকে পরিত্রাণের আর কোন উপায় নেই। সন্তানের বন্ধু হতে হবে অভিভাবককে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কলেজে যাচ্ছে কিনা, গেলে ঠিকমতো ক্লাস করছে কিনা, এসব বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারা যা বলে সেটা অন্ধের মতো বিশ্বাস না করে শিক্ষকদের কাছ থেকে যাচাই করে নিতে হবে। আমরা শিক্ষকদের সাথে অভিভাবকদের সেতুবন্ধন রচনা করতে চাই। যাতে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কখনো পথ না হারায়।’
এদিকে সরকারি আবুল কালাম কলেজের এ অভিনব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বরিশাল বিমানবন্দর প্রেসক্লাব সভাপতি ও সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটির বাবুগঞ্জ উপজেলা সম্পাদক আরিফ আহমেদ মুন্না বলেন, ‘বর্তমানে দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মোবাইল জড়িত। মোবাইল আমাদের সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। অনেক পরিবারে দাম্পত্য কলহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের কারণ মোবাইল। মোবাইলে সময় নষ্টের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ধ্বংস হচ্ছে। তাদের নৈতিক স্খলন দেখা দিয়েছে। মোবাইলের ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তারা অসৎ সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাই মোবাইলের অপব্যবহার রোধে কলেজ কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক।
উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইসহাক শরীফ এ উদ্যোগকে অনন্য ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয় উল্লেখ করে জানান, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনে মোবাইল এখন আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষক এবং অভিভাবকের মধ্যে যোগাযোগ না থাকার অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সরকারি আবুল কালাম কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থী অভিভাবকদের ডেকে ওপেন ডায়ালগের মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।