*তিন বছরে আড়াই হাজার *সবচেয়ে বেশি ২০১৯ সালে

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল :- দক্ষিণাঞ্চলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরমধ্যে চলতি মাসের প্রথম দুইদিনে বরিশাল ও ঝালকাঠিতে পাঁচটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ৬৩টি বসত ঘর ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পরেছেন ক্ষতিগ্রস্থরা। আগুনে প্রায় তিন কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চলতি মার্চ মাস-ই শুধু নয়; পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সাল বিগত বছরগুলোর অগ্নিকান্ডের ঘটনার রেকর্ড ভেঙেছে।

অগ্নিকান্ড নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অসতর্কতাই ছিল প্রধান কারণ। ফলে কখনও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, রান্নাকরা চুলা, সিগারেটের আগুন কিংবা অন্যকোনো কারণে আগুনের সূত্রপাত ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তি সর্তকতার পাশাপাশি আগুনের সূত্রপাত হতে পারে এমন অনুষঙ্গের পরিবর্তন, পর্যবেক্ষণ না হলে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। একইসাথে প্রয়োজনে এসব বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি ও ফায়ার সার্ভিসকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রতিবছরের অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কে ‘বার্নিং সিজন’ বলা হয়। এরমধ্যে আবার মার্চ ও এপ্রিল মাসে বেশি আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। যেকারণে এ সময়কে আলাদা করে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। গত তিন বছরে বরিশাল বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিনটি কারণে এ অঞ্চলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাসসহ বিভিন্ন রান্নাকরা চুলা ও সিগারেটের অগ্নিকণা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরের হিসেবে পর্যায়ক্রমে অগ্নিকান্ডের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। তিন বছরে সংঘটিত দুই হাজার ৪৮৫টি দুর্ঘটনার মধ্যে শর্টসার্কিটের কারণে এক হাজার ৩৬টি, গ্যাসসহ বিভিন্ন রান্না করার চুলার কারণে ৫৯৪টি এবং সিগারেটের অগ্নিকণার কারণে ৩৩৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সূত্রমতে, ২০১৭ সালে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় (বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি) মোট ৭৮৯টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ওইবছর যথারীতি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে বেশি দুর্ঘটনা হয়, যার সংখ্যা ছিলো ২৯৬টি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গ্যাসসহ বিভিন্ন চুলার কারণে ১৯৬টি এবং সিগারেটের অগ্নিকণার কারণে ১৩০টি দুর্ঘটনা হয়েছে। এর বাইরে ২০১৭ সালে শত্রæতামূলকভাবে তিনটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া খোলাবাতি, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে, রাসায়নিক, স্থিরবিদ্যুৎ, মিস ফায়ার, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বাকি ১৬৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে খোলাবাতি ব্যবহারের কারণে সর্বোচ্চ ৪২টি, অজ্ঞাত কারণে ৪১টি অগ্নিকান্ড ঘটেছে। সবমিলিয়ে ওইবছর মোট ক্ষতি হয়েছে ২৮ কোটি ৯১ লাখ তিন হাজার ৩৮৫ টাকার সম্পদ। আর উদ্ধার হয়েছে ৭১ কোটি ৫১ হাজার ২৮৫ টাকার সম্পদ।

পরের বছর ২০১৮ সালে আগুন লাগার ঘটনা একটু কমে আসে। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে ১৮৩টি দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে ৬০৬টিতে দাঁড়ায়। এরমধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে হয় ২৭৮টি। গ্যাসসহ বিভিন্ন চুলার কারণে ১৬৫টি, সিগারেটের অগ্নিকণার কারণে ৩৪টি, খোলবাতির কারণে ৩২টি ও অজ্ঞাত কারণে ৫৩টি ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। বাকি ৪৪টি ঘটনা অন্য কারণে হয়েছে। সবমিলিয়ে ওইবছর মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি ৮১ লাখ পাঁচ হাজার ৩৫ টাকার সম্পদ। আর উদ্ধার হয়েছে ১২৬ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৬২৫ টাকার সম্পদ।

তবে পরের বছর ২০১৯ সালে পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে মারাত্মক আকার ধারণ করে আগুন লাগার সংখ্যা। ওইবছর বিভাগে এক হাজার ৯০টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে সবচেয়ে বেশি ঘটলেও পাল্লাদিয়ে বাড়ে গ্যাস বা চুল্লি ও সিগারেটের অগ্নিকণায় আগুন লাগার সংখ্যা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের এক হাজার ৯০টি অগ্নিকান্ডের মধ্যে ৪৬২টি সংঘটিত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এছাড়া গ্যাসসহ বিভিন্ন চুলার কারণে ২৩৩টি, সিগারেটের ফেলে দেওয়া অংশের কারণে ১৬৯টি, খোলাবাতির কারণে ৪৮টি ও অজ্ঞাত কারণে ৮৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এরবাইরে অন্য কারণে ৮৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। ওইবছরই তিনবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বরিশাল বিভাগে। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দাঁড়ায় ১৪ কোটি ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ১০০ টাকার সম্পদ। আর উদ্ধার হয়েছে ৮৮ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার সম্পদ।

২০২০ সালের চলতি মার্চ মাসে সবচেয়ে বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে গত ২ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ডে। অজ্ঞাতকারণে ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডে ২৫টি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও ১৫টি আংশিক ভস্মিভূত হয়ে প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে ৪০জন ব্যবসায়ী এখন পথে বসেছে। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা পোড়াবর্জ অপসারন করে পূর্ণরায় দোকান ঘর তুলতে গেলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের ঘর তুলতে বাঁধা প্রদান করেছেন। কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের জানিয়েছেন, নতুন করে কেউ ঘর তুললে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘোষণার পর ফের হতাশ হয়ে পরেছেন ক্ষতিগ্রস্থ ৪০জন ব্যবসায়ীরা। মানবিক কারনে তারা পূর্ণরায় ঘর তুলে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়ার জন্য প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবী করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগুন লাগার সাথে সাথে গৌরনদীর দমকল কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও পাম্প বিকল হওয়ার অজুহাতে দুইঘন্টায়ও তারা আগুন নেভানোর কাজ করতে পারেনি। ততক্ষনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে তাদের সব পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বরিশাল সদর স্টেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাইফুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর দক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে ঘরের বৈদ্যুতিক ক্যাবল, সুইচগুলো যাচাই করে দেখা, গ্যাসের চুলার পাইপ ও রেগুলেটর প্রতিনিয়ত চেক করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন করে লাগানো নিরাপত্তার জন্য ভালো। কিন্তু তা কখনোই করা হয়না, ফলে অগ্নিকান্ডের ঘটনার যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে খেসারতও বেশি দিতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বরিশাল বিভাগের ৪২টি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৩৮টি স্টেশন রয়েছে। তারমধ্যে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত স্টেশন মাত্র তিনটি, ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত ২৩টি এবং ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত ১০টি। অপরদিকে বরিশালের মুলাদী ও বরগুনার তালতলীতে স্টেশন নির্মাণের কাজ চললেও আগৈলঝাড়া ও পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালী উপজেলায় কোন স্টেশন নেই।

Share.
Exit mobile version