পানি.. পানি….
১০ মহররম ও ১৫ আগস্ট: মুসলমানদের কাপুরুষতা, লোভ ও লজ্জার অনন্য নজির
হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (র.) ও তার পরিবারবর্গ কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাদের এ আত্মত্যাগ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর ক্ষত ও মর্মান্তিক শোকের কারন।
সায়্যিদুনা ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালাম পরিবার পরিজন সমেত কুফা অভিমূখে যাচ্ছেন। দুধের শিশু হজরতে আলি আসগর থেকে বোন হজরত সায়্যিদাহ জয়নব রা. পর্যন্ত সকলেই আছেন কাফেলাতে৷ অভিশপ্ত ইয়াজিদের সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ ১০০০ সৈন্য নিয়ে ইমামের কাফেলার ডাইরেকশন পরিবর্তন করে দিল৷ ইমাম হোসাইন রা. কুফার রাস্তা থেকে সড়ে এসে কারবালা প্রান্তরের দিকে আসতে বাধ্য হলেন৷ তাবু গাড়লেন কারবালা প্রান্তরে। ফোরাত নদীর পানি অবরুদ্ধ করে দিল পাপিষ্ঠ ওমর ইবনে সা’দ ও শিমারের সৈন্যরা।
ইমাম হোসাইন রা. তিনটি প্রস্তাব রাখলেন অভিশপ্ত ওমর ইবনে সা’দের কাছে। ১. আমাকে মক্কা শরিফে ফিরে যেতে দাও। ২. আমাকে ইয়াজিদের সাথে আলোচনা করার সুযোগ দাও। ৩. আমাকে তুর্কী সীমান্তে যেতে দাও
আহলে বায়তের নামে জান বাজী রাখা ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবির একজন হজরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এঁর সন্তান ইয়াজিদ সেনাপতি ওমর ইবনে সা’দ বলল, আমাদের আমির(বসরার গভর্নর) উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের হাতে আপনাকে আনুগত্যের বায়য়াত নিতেই হবে। এছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা আপনার সামনে খোলা নেই। ইমাম হোসাইন রা. বললেন, আমি কস্মিনকালেও মারজানার ছেলে উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের হাতে বায়াত নেব না।
যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠল৷ যুদ্ধ? আসলে কী যুদ্ধ বলা চলে একে? ২২,০০০ ইয়াজিদ সৈনিকের বিপরীতে ইমাম শিবিরে ৭২ জন অস্ত্রধারী পুরুষ। বাকি সবাই নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু।
ইমাম হোসাইন রা. জীবনের শেষ ভাষণ দেয়ার জন্য কারবালা প্রান্তরে এগিয়ে গেলেন৷ ছুড়ে দিলেন সেই ঐতিহাসিক প্রশ্নঃ
“তোমাদের মাঝে কী একজনও মুসলমান নেই?”
ইমাম হোসাইন রা. বলতে লাগলেন, তোমরা কেন আমাকে হত্যা করবে? আমার কী অপরাধ? তোমরা আমাকে হত্যা করে কাল হাশরের দিনে আমার নানাজীর সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে? আর তোমরা কী জান না হাউজে কাওসারে আমার নানাজীর দুই পাশে আমি এবং আমার ভাই ইমাম হাসান দাড়িয়ে থাকবো?
ইমাম হোসাইন আলাইহিস সালামের মর্মস্পর্শী ভাষণে একজনের হৃদয় আন্দোলিত হতে লাগল৷ তিনি সেই অভিশপ্ত ইয়াজিদের সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ। যিনি ইমামের কাফেলাকে কুফার ডাইরেকশন থেকে সড়িয়ে কারবালাতে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি লজ্জা ও অনুশোচনা নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ইয়াজিদ শিবির থেকে ইমাম হোসাইন রা. এঁর কাছে ছুটে এসে আত্মসমর্পণ করলেন। বললেন, হে ইমাম! আমাকে অপরাধ মার্জনা করে কবুল করুন।
ইমান হোসাইন রা. বললেন, হে হুর! তুমি একি করছ? তুমি কী জাননা আমার সাথী হলে আজ শাহাদাত ছাড়া আর কিছুই পাবে না?
সায়্যিদুনা হুর ইবনে ইয়াজিদ রা. বললেন, হে ইমাম! আমি আপনার পদতলে কুরবান হতেই এসেছি।
হজরত ইমাম হুসাইন মাত্র ৭০ জন সঙ্গী নিয়ে মুসলিম নামধারী স্বৈরাচার ইয়াজিদ বাহিনীর ২২০০ হাজার সৈন্যের সাথে ১০ মহররম ভোর থেকে লড়াই শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকে ছিলেন।
অসম এই যুদ্ধ চলতে লাগল৷ সায়্যিদুনা হুর ইবনে ইয়াজিদ (রা.)ও অসীম সাহসিকতার সাথে বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাৎ বরন করলেন।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হুসাইন এর শিশু পুত্র আজগর পানি খেতে চাইলে তিনি পুত্রকে কোলে নিয়ে ইরাকের ফোরাত নদীর তীর অবরুদ্ধ করে রাখা ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে শিশুপুত্রের জন্য পানি চাইলেন.. তারা পানি দেয়ার বদলে শিশু আজগরকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়ে মারে যাতে আজগর নিহত হয়। ।ইমাম হুসাইন পুত্রের লাশ নিয়ে তাঁবুতে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
সাহাবা ও তাবেঈদের সবাই এক এক করে শহীদ হলেন। শেষে কেবল ইমাম হোসেন (র.) বেচে ছিলেন। তখম ক্লান্ত, শ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত ইমাম হোসেন (র.)সীমার বীন যুল যাওশান নামের পাশন্ডর বর্শার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে ফেলে হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সূর্যদয়ের আগেই বাঙালি জাতিকে মুক্তির স্বাধ দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ১৮ জনকে এই পৃথীবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পাষন্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল, শিশু বাবু, এমনকি অস্তঃসত্ত্বা বধূও।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিল খামাখাই উত্তেজনা। পরদিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা সতর্ক তা নিয়েই। কিন্তু কে জানত সে সময়ই উত্তরপাড়ায় চলছে বঙ্গবন্ধু হত্যার মহড়া।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়ে উঠল সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট যানগুলো। রাত ১০টায় বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে জড়ো হলো বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ বিরান মাঠে। জড়ো হলো ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক। রাত সাড়ে ১১টায় জড়ো হলো মেজর ডালিম, মেজর নূর,মেজর হুদা,মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা,মেজর রাশেদসহ ঘাতকরা। ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহর রাত সাড়ে ১২টায় পরিকল্পনা ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। এই প্রথম সবাই জানতে পারল সে রাতেই হত্যা করা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
তখন ভোর সোয়া ৫টা। আক্রান্ত হয়েছে ধানমন্ডি। চারদিকে ছুটছে বুলেট। ভোর ৫টা ১০মিনিটে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হয় ধানমন্ডির শেখ মণির বাসার গেটে। প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো তখন ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ড্রয়িং রুমে বসে পড়ছিলেন পত্রিকা। খোলা দরজা দিয়ে সটান ঢুকে পড়ে মোসলেম। কিছু বলতে চাইছিলেন শেখ মণি। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে গর্জে উঠল মোসলেমের হাতের স্টেনগান। লুটিয়ে পড়লেন শেখ মণি। চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ব্রাশফায়ারে প্রাণ হারালেন তিনিও। কেবল প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।
ভোর ৫টা ১৫ মিনিট। ধানমন্ডির আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে এক প্লাটুন সৈন্য। পাহারারত পুলিশকে নিরস্ত্র করতে ছোড়া হয় গুলি। গুলির শব্দে জেগে ওঠেন সেরনিয়াবাত। ব্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করতে। সে সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ঘাতকরা। ড্রয়িং রুমে জড়ো করা হয় সবাইকে। তারপর নির্দয়ভাবে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী,১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগনে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই),তিন অতিথি এবং চার কাজের লোককে। কেবল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তখন ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। দুটো অপারেশন শেষ করে ঘাতকদের ভিড় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর সেই ৬৭৭ নম্বর বাড়ির গেটে। ততক্ষণে আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে হত্যার খবর জেনে গেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রধান গেটেও চলছে হট্টগোল। বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন দুই গৃহকর্মী মোহাম্মদ সেলিম (আবদুল) ও আবদুর রহমান শেখ (রমা)। নিচতলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম। মহিতুলকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা…।’কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না মহিতুল। চেষ্টা করতে থাকেন গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে।
গোলাগুলির শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন গৃহকর্মী আবদুল আর রমা। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে এসে দেখেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত রমা বাড়ির ভেতরে এসে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন। রমা দোতলায় উঠে গেলেন। দেখলেন, আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন বেগম মুজিব। রমা এবার চলে যান তিনতলায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল।
পিছু পিছু সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। তিনতলা থেকে আবার দোতলায় নেমে আসেন রমা। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান। বাইরে তখন গোলাগুলি। নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধু। তার সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে মহিতুলের কাছ থেকে রিসিভার টেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব…।’ ব্যস, এ পর্যন্তই। কথা শেষ হলো না তার।
জানালার কাচ ভেঙে একঝাঁক গুলি এসে লাগে অফিসের দেয়ালে। এক টুকরো কাচে ডান হাতের কনুই জখম হয় মহিতুলের। টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। কাছে টেনে শুইয়ে দেন মহিতুলকেও। এর মধ্যেই আবদুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থামলে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। পাঞ্জাবি ও চশমা পরেন। অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই নিচে নামেন শেখ কামাল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নূরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে মেজর নূর, মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা।
গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডসআপ’বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যান নূরুল ইসলাম খান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।’মহিতুল ঘাতকদের বলেন, ‘উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ। প্রাণ হারান তিনি। একটা গুলি এসে লাগে মহিতুলের হাঁটুতে, আরেকটা নূরুল ইসলামের পায়ে।
ক্যান ইউ গেট আউট?
নিচতলার বারান্দা তখন রক্তে ভাসছে। বন্ধ ঘরের ভেতর ফোনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ফোনের ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং,ক্যান ইউ গেট আউট?’
বঙ্গবন্ধুর কথা শোনার পর ব্যক্তিগত লালরঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা দেন কর্নেল জামিল। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েন উদ্দিন মোল্লা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছা হলো না তার। পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েন উদ্দিন। তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে লম্বালম্বি লাইনে দাঁড়ানো মহিতুল,নূরুল ইসলাম, আবদুল মতিন ও পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ কয়েকজন। ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করে। তারপর গুলি করতে করতে চলে যায় ওপরে। সেখানে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া আবদুলকে গুলি করে।
ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনিসহ বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাতকরা। ততক্ষণে গোলাগুলি থেমে গেছে। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে ঘাতকরা। নামিয়ে আনতে থাকে নিচে। সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘তোরা কী চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’ মেজর হুদা বলে, ‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কী করেছিস?’ উত্তরে হুদা বলে, ‘স্যার, কামাল তার জায়গায়ই আছে। আর আপনি তুই তুই করে বলবেন না। আপনি বন্দি। চলুন।’এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘কী, তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মিরা আমাকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।’
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে রক্তের স্রোত
সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সিঁড়ির নিচে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও মেজর নূর। নূর কিছু একটা বললে সরে দাঁড়ায় মহিউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে হুদা ও নূরের হাতের স্টেনগান। আঠারটি গুলি ঝাঁজরা করে বঙ্গবন্ধুর বুক ও পেট। বিশালদেহী মানুষটি ধপাস করে পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। বঙ্গবন্ধু তখন মৃত। তার বুকের রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের স্রোত।
কিছুক্ষণ পরই দোতলায় উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। সঙ্গে সৈন্যরা। গুলি আর ধাক্কায় একসময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম মুজিব। সবাইকে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দেয় ঘাতকরা। নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেগম মুজিবকে। তারপর সেই ঘরে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন একে একে গুলি করে হত্যা করে বেগম মুজিবসহ শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ-দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে আসে সুলতানা কামালের মুখ।
‘পানি… পানি…’
নিচে দাঁড় করানো হলো শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে। শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে?’ অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। গুলি করা হয় সেখানে। অসহায় নাসেরের গুলিবিদ্ধ দেহ গড়াতে থাকে মেঝেতে। এ সময় ‘পানি… পানি…’ বলে গোঙাতে থাকেন তিনি। পানি নয়, ঘাতকরা আরেকবার গুলিবর্ষণ করে তার ওপর।
‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’
রমাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও। অসহায় শিশুটি প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ কোনো জবাব নেই রমার মুখে। মহিতুল বলেন, ‘না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’একথা শুনে শিশুটি তার মায়ের কাছে যেতে চায়। দোতলায় নিয়েও যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু মা নয়, পাঠানো হয় মৃত্যুর কোলে। গুলি করে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসে। থেঁতলে যায় মাথার পেছনের অংশ। নিথর রক্তমাথা একরত্তি দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।
বেঁচে যান দুই মেয়ে
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও।
১৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ শেখ আবু নাসেরের তৃষ্ণার্ত হৃদয় পানি পানি বলে গোঙাতে থাকলে পানির পরিবর্তে বুকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। একইভাবে কারবালার প্রান্তরে পানির জন্য ছটফট করা ইমাম হোসেন( র.) এর শিশু পুত্র আজগরের জন্য পানি চাইলে তীর নিক্ষেপ করে তার বুক বিদীর্ণ করে দেয়া হয়। অতচ এরা নাকি মুসলিম, রাসুল ( সঃ) উম্মত! যারা ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে আহলে বাইয়াত ইমাম হোসেন (র.) এর বংশ নৃবংশ করলো কিংবা জাতির পিতার সীমাহীন ত্যাগ ও ভালোবাসাকে দুর্বলতা ভেবে স্ত্রী, পুত্র, অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ, আত্নীয় পরিজন ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করলো তারা কি পাশন্ড সীমারের চেয়ে বেশি নির্মম নয়? আর আমর বিন সাদ, সীমার বিন জুলযাওশান ও ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ এর নারকীয় হত্যাকান্ডের সুফল ভোগী ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া কিংবা ফারুখ, রশিদ, ডালিম, মোসলে উদ্দিন, হুদা, নুরদের পাশবিকতার সুবিধাভোগী ও পৃষ্ঠপোষক মোস্তাক- জিয়া কি ইতিহাসের নিকৃষ্টতম লোক নন?
পরবর্তীতে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে যেমন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে তেমনি জাতির পিতা হত্যার মাস্টারমাইন্ড জে. জিয়াও নির্মম হত্যার শিকার হন। জিয়া পরিবার এখনও তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করছে।
লেখকঃ ওয়াসীম উদ্দিন জুয়েল।
সাবেক ছাত্র নেতা।