তিন বছর পর পর ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর প্রস্তাব
রাঙা প্রভাত ডেস্কঃ দেশে বর্তমান সর্ববৃহৎ সেতু যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু। এ সেতুসহ ষষ্ঠ বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী (মুক্তারপুর) সেতুর টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। যানবাহনের ধরন অনুযায়ী ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল। মুক্তারপুর সেতুর টোল বাড়ছে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। সে হিসাবে সেতু দুটিতে বর্তমানে আদায় করা হারের ২০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
নতুন টোলের হার কার্যকর হলে পরবর্তী ৩ বছর পর পর ৫ শতাংশ হারে বাড়বে। পুনর্নির্ধারিত টোল অনুমোদিত হলে বাড়তে পারে জীবনযাত্রার ব্যয়। যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া বেড়ে যাবে। গড়ে ৪৫ শতাংশ ভাড়া বাড়লে উত্তরাঞ্চল থেকে বহন করা সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। টোলের হার বৃদ্ধির উছিলায় কয়েকগুণ গাড়ি-ভাড়া বাড়ানোর শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতু পরিচালিত হয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে। ১৯৯৭ সালে নির্ধারণ করা হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল হার। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। মুক্তারপুর সেতুর টোল নির্ধারণ করা হয় ২০০৮ সালে। এবার সেতু দুটির টোল বাড়ছে গড়ে ৪৫ শতাংশ হারে। পাশাপাশি পণ্যবাহী যান ট্রেইলারকে টোলের আওতায় নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রস্তাবটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ১০৯তম বোর্ডসভায় উত্থাপনের কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক ও সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, অনেক দিন ধরে সেতুর টোল বাড়ে না। এটি খুব দরকার। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় এটি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ বিভাগের সম্মতি লাগবে। এখন বোর্ডসভার মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া হচ্ছে।
সেতুর টোল বৃদ্ধির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেতুতে মোটরসাইকেলের বিদ্যমান টোল ৪০ টাকা। ৫০ ভাগ বাড়িয়ে ৬০ টাকা হচ্ছে। কার ও জিপের মতো হালকা যানবাহনের জন্য নেওয়া হয় ৫০০ টাকা। সেই টোল বেড়ে হবে ৭০০ টাকা। এখানে ৪০ শতাংশ বাড়ছে। মাইক্রোবাস ও পিকআপ (দেড় টনের কম) হলে ৬০ শতাংশ টোল বেড়ে দাঁড়াবে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। ছোট বাস ৩১ আসন বা এর কমের হলে ৬৫০ টাকা টোল নেওয়া হয়। ৩৮ শতাংশ বেড়ে টোলের হার ধরা হবে ৯০০ টাকা। বড় বাস ৩২ আসন বা তার বেশি হলে এখন নেওয়া হয় ৯০০ টাকা। এখানে ৪৪ শতাংশ টোল বাড়িয়ে ১৩০০ টাকা ধরা হয়েছে। ছোট ট্রাক দেড় টন থেকে ৫ টনের হলে ৮৫০ টাকা টোল। ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে সেই টোল হচ্ছে ১২০০ টাকা। মাঝারি ট্রাক ৫ টন থেকে ৮ টনের হলে ১১০০ টাকার পরিবর্তে ১৬০০ টাকা নেওয়া হয়। ৮ টনের বেশি ওজনের বড় ট্রাকের বর্তমান টোল ১৪০০ টাকা। এটি ৪২ ভাগ বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করা হচ্ছে।
নতুন করে টোলের আওতায় আসছে পণ্যবাহী যান ট্রেইলার। ৪ এক্সেল পর্যন্ত হলে ৪ হাজার টাকা টোল আর এর বেশি হলে প্রতি এক্সেলে ১৫০০ টাকা যোগ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের আওতায় নির্মিত মুক্তারপুর সেতুর টোলের হারও পুনর্নির্ধারিত হচ্ছে। এ সেতুতে বর্তমানে তিন চাকার ভ্যান বা মোটরসাইকেল পারাপারে ১০ টাকা টোল নেওয়া হয়। এটি বেড়ে হবে ২০ টাকা। অর্থাৎ ১০০ ভাগ বাড়ছে। এ ছাড়া সিএনজি অটোরিকশা ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা, কার/জিপ ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা, মাইক্রো/ টেম্পো/পিক-আপ ৪০ টাকা থেকে ৮০ টাকা টোল ধার্য করা হচ্ছে। এ ছাড়া ছোট বাস ১০০ টাকার পরিবর্তে দিতে হবে দেড়শ, বড় বাস হলে ২০০ টাকার পরিবর্তে গুনতে হবে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া ছোট ট্রাকের ক্ষেত্রে ১৫০ টাকার বর্তমান টোল বেড়ে হবে ২০০, মাঝারি ট্রাক হলে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৪০০; বড় ট্রাকের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকার টোল গুনতে হবে ৬০০ টাকায়। মুক্তারপুর সেতুতেও ট্রেইলারের জন্য নতুন করে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে ৪ এক্সেল পর্যন্ত ১ হাজার টাকা আর বেশি হলে এক্সেলপ্রতি ৭৫০ টাকা যুক্ত হবে। এবার নতুন টোলের হার কার্যকর হলে পরবর্তী ৩ বছর পর পর সেতু দুটির টোল হার ৫ শতাংশ হারে এবং ১০-এর গুণীতক হিসেবে বাড়ানোর সুপারিশ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, সেতু কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সেতু দুটির টোল হার নির্ধারণ হয়েছে ১০ বছর আগে। বিদ্যমান টোলহার, ট্রাফিক পূর্বাভাস, সেতু কর্তৃপক্ষের আয়-ব্যয়, সেতুর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ডেবিট সার্ভিস লায়াবিলিটি (ডিএসএল) পরিশোধের স্বার্থে টোল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। সেতু দুটির টোলের অর্থ দিয়েই চলে সেতু কর্তৃপক্ষের ব্যয়। ডিএসএল বাবদ প্রতিবছর প্রায় ২৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনে এর মাত্রাও বাড়ে। তা ছাড়া টোল থেকে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট এবং নিট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আইটি পরিশোধ করে সংস্থাটি। তা ছাড়া গত অর্থবছরে সংস্থার উদ্বৃত্ত ৪০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত দুটি প্রকল্প, সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় বহন করা হয় টোল থেকেই। এ জন্য গড়ে ৪৫ শতাংশ টোলের হার বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতু দিয়ে ৪ এক্সেল এবং তার অধিক এক্সেলবিশিষ্ট ট্রেইলার পারাপার হচ্ছে। শ্রেণিবিন্যাস না থাকায় বড় ট্রাক হিসেবে টোল নেওয়া হয়। এ জন্য ট্রেইলারকে একটি শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে এক্সেলভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত এর আগে সেতুর টোল বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল। এর জবাব মেলেনি।
এদিকে চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের একটি টিম ষষ্ঠ বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী (মুক্তারপুর) সেতুর টোল কালেকশন সিস্টেম ও চলমান উন্নয়নকাজ পরিদর্শন করে। ওই টিম তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে মুক্তারপুর সেতুর টোল বৃদ্ধির সুপারিশ করে। পরবর্তী সময়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল হার পুনর্নির্ধারণে চিঠি দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৭ সালে টোল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় গঠিত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হলে অর্থবিভাগ সে সময় সম্মতি দিয়েছিল। এর পর দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় নতুন করে টোলের হার নির্ধারণ করে সেতু কর্তৃপক্ষ। আগামীকালের অনুষ্ঠেয় বোর্ডসভায় প্রস্তাবটি এজেন্ডাভুক্ত বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।