বিশেষ প্রতিনিধি।। কীর্তিমান রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর নেই। শুক্রবার গভীর রাতে তিনি মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
বেশ কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ মুহিতকে শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানায়। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে ছিলেন তিনি। গত ৫ মার্চ রাজধানীর বনানীর বাসায় তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলে তাকে বাসায় নেওয়া হয়।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় তারা মুহিতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারে প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
মুহিতের প্রথম জানাজা আজ সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর গুলশান আজাদ মসজিদে এবং দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ১১টায় সংসদ প্লাজায়। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দুপুর ১২টায় তার মরদেহ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার লাশ নেওয়া হবে সিলেটে।
১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মুহিত। শিক্ষা, সরকারি চাকরি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য মিলিয়ে বর্ণাঢ্য জীবন তার। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভাষাসংগ্রামেও অংশ নিয়েছেন। তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এরপর টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮২ থেকে ‘৮৩ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দিয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে অবসর নেন রাজনীতি থেকে। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত, ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি ও মেয়েকে নিয়ে থাকতেন বনানীতে নিজ বাড়িতে।
মুহিতের বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। মুহিতের আরও ১২ ভাইবোন ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে ১০ জন জীবিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তার ভাই।
সংস্কৃতিমনা পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু-কিশোর সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সৃজনশীল চর্চা অব্যাহত ছিল।
মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে স্কুলছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি অপফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস-এ (সিএসপি) যোগ দেওয়ার পর এম এ মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। তবে এই দায়িত্ব গ্রহণ না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এখন পর্যন্ত তিনি একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অনন্য ভূমিকা রাখেন তিনি।
১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৯১ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষণিক দেশে অবস্থান করে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের সুশীল সমাজের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃৎ এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ২০০১ সালের আগস্টে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে সিলেট-১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ২০১৪ সালে সিলেট-১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি আবারও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে আর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের ঘোষণায়ও তিনি ব্যতিক্রম। অবসর নিয়েও মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের জাতীয় অনুষ্ঠানে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী প্রাণবন্ত মানুষ। সদা হাস্যোজ্জ্বল কর্মযোগী, ধ্যানী, ধীমান মুহিতের স্পষ্টতা, সরলতা ও সাহসিকতা সকল মহলে প্রশংসিত।
লেখক হিসেবেও আবুল মাল আবদুল মুহিত খ্যাতিমান। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিষয়ে তার ‘জেলায় জেলায় সরকার’ একটি আকর গ্রন্থ। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর এবং গণতান্ত্রিক জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রশাসনিক প্রতিবেদন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। মুহিতের স্ত্রী সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।