বিশেষ প্রতিনিধি।। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়া ঝরনায় ঘুরতে গিয়ে সলিল সমাধি হয়েছে দুই সহোদরসহ তিন শিক্ষার্থীর। নিখোঁজের প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর তৌফিক আহম্মেদ তারেকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের দুয়ার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে সোমবার বিকেল ৪টার দিকে নিখোঁজ দুই সহোদরের একজন তানভীরের লাশ উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে এক সাথে দুই সহোদর তাদের এক বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে যায় মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়া ঝরনায়। রোববার বিকেলে তারা তিনজনই নিখোঁজ হলে দিবাগত রাতে ঝরনা থেকে ইশতিয়াকুর রহমান প্রান্ত-এর লাশ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার সকালে তারেক, তানভীর ও ইশতিয়াক চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে নাপিত্তাছড়া ঝরনা দেখার উদ্দেশে বের হন। তারা ঝরনা এলাকার একটি টি-স্টলে নিজেদের ব্যাগ রেখে ঝরনার চূড়ায় উঠেন। এরপর তারা তিনজনই নিখোঁজ হন। তবে ঝরনার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে মিরসরাই থানা পুলিশে খবর দেয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা রাত ৮টার দিকে নিখোঁজ ইশতিয়াকের লাশ উদ্ধার করে।
মৃত ইশতিয়াক চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর বি-ব্লকের বাসিন্দা জনতা ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ জাকারিয়ার ছেলে।
মিরসরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কবির হোসেন বলেন, রোববার ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ইশতিয়াকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর সোমবার বিকেল ৪টায় ঝরনা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে খাল থেকে তানভীরের লাশ পাওয় যায়। সর্বশেষ মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ঝরনা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে দুয়ার খাল থেকে তারেকের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। লাশের সুরতহাল শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ইশতিয়াকের বাবা মোহাম্মদ জাকারিয়া অভিযোগ করে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু জানান, ১২ নম্বর খৈয়াছড়া ইউনিয়নের নয়দুয়ারিয়া এলাকার নাপিত্তাছড়া ঝরনা পর্যটকদের কাছে উৎসবের জায়গা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসেন। ঝরনাটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এখানে যাতায়াত, নিরাপত্তা ও কোনো রকম অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নেই। প্রাকৃতিক এ ঝরনায় বন বিভাগ কোনো কাজ না করেই বছর বছর ইজারা দিয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, সোমবার দিনভর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় ঝরনার নিচে তীব্র স্রোত ছিল। যার ফলে ওপর থেকে পড়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নাপিত্তাছড়া ঝরনার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিএসআর ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে আমরা রোববার টিকিট কাউন্টার বন্ধ রাখি। পর্যটকও খুব কম ছিল। এই তিনজন রোববার বেলা ১১টার দিকে ঝরনায় গেছে শুনেছি।’
ঝরনায় কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গাইড নিয়োগ করা হয়নি এমন প্রশ্নের সদুত্তোর দিতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
ইশতিয়াকের বন্ধু আলিফ মোহাম্মদ বলেন, ‘ইশতিয়াক শান্ত স্বভাবের মেধাবী ছাত্র ছিল। তিনি এইচএসসিতে এ+ পেয়েছে। এবার বিএমএ ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। তিনি বন্ধুদের সাথে এর আগেও ঝরনায় গিয়েছেন। এখানে ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা নেই, নিরাপত্তা নেই, সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না করে পাহাড়ের একটি প্রাকৃতিক ঝরনা প্রতি বছর ইজারা দিচ্ছে বন বিভাগ। আজ অবকাঠামো ও পর্যটকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলে হয়ত এ দুর্ঘটনা হতো না।’
মৃত তানভীর ও তারেকের মামা মো: তৌহিদুল ইসলাম সুমন জানান, আমার বোন-বোন জামাইয়ের সব শেষ হয়ে গেছে। একসাথে দু‘জন ছেলেকে হারাতে হবে কোনো দিন চিন্তা করতে পারেনি। দুলাভাই অসুস্থ হয়ে বাসায় থাকেন। পড়াশোনা শেষ করে দুই ছেলে সংসারের হাল ধরার কথা, অথচ দু‘জনই চলে গেল।
জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে বন বিভাগ নিরাপত্তা, চলাচলের রাস্তা, অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা ও পর্যটকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে বছরের পর বছর ইজারা দিচ্ছে। গত বছর ৮ মার্চ থেকে আগামী ২৮ এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত এক বছরের জন্য খৈয়াছড়া ঝরনা ও নাপিত্তাছড়া ঝরনা ২২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ধরে ইজারা পেয়েছে শেরপুর জেলার শ্রীবরদি উপজেলার তাতীহাটি ইউনিয়নের মেসার্স টিএসআর ইন্টারন্যাশনাল। তারাও কোনো কাজ না করে শুধু টিকিট বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘তিনজন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক। এখানে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব ছিল। কেউ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। আমরা উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছি। এটি বন্ধ করে একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসব।