স্বর্ণলতা
বুকে চাপা কষ্ট থাকলেও স্বর্ণলতাকে এখনো আগের মতো ভালোবাসে আতিকুল। স্বর্ণলতার প্রতি তার ভালোবাসাটা অনেক পুরোনো। তাদের বাড়ির চারপাশে ছিল অজস্র স্বর্ণলতার সমারোহ। সোনালি আলোর আভা ছড়ানো স্বর্ণলতার সমাহার উপভোগ করত অবসরে। আহ, কী সৌন্দর্য! সোনালি সৌন্দর্য! কখনো সে স্বর্ণলতাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতো, কখনো আদর করতো আর কল্পণায় হারিয়ে যেত। আর মনে মনে ভাবতো তার মনের মানুষকে যাকে সে কখনো সে দেখে নি। তবে মনে মনে তার একটা ছবি একে রেখেছে। নিশ্চয়ই সে স্বর্ণলতার মতোই দিপ্তি ছড়াবে তার সমস্ত হৃদয় জুড়ে। সোনালি আলোয় ভরিয়ে দেবে তার জীবনের প্রতিটা অলি গলি। কল্পণার সেই মানুষটির সাথে একদিন স্বপ্নে দেখা হয়েছিল তার। কিন্তু চেহারাটা মনে পড়ছে না। তবে তার বিশ্বাস মনের মানুষকে ঠিকই চিনে নিতে পারবে। কোথায় দেখা হয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে বাসক গাছের ঝোপের ওখানে একটা বসার জন্য বেঞ্চের মতো আছে। সেখানে আতিকুল মাঝে মধ্যেই বসে সময় কাটায়। ঠিক সেখানেই বসেছিল সে। শুধু এক নজর দেখতে পেরেছিল। তাতেই স্বপ্নকণ্যার প্রেমে পাগলপারা হয়ে যায় আতিকুল। পরক্ষণেই ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভাঙ্গে তার। বাসক ঝোপের কাছে, বেঞ্চে সময় কাটানোর মাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। সেখানে গেলেই ভাল লাগে। স্বপ্নকণ্যার অপেক্ষায় থাকে সে। স্কুলে, কলেজে, অনুষ্ঠানে সকল জায়গায় মেয়েটাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও তার দেখা মেলে না। তবুও কোনো হতাশা নেই তার। উপরন্তু, মনের মানুষের জন্য একটা নামও ঠিক করে রাখে সে।
নদীতীরে বসবাস আতিকুলদের। দাদার আমলের ডিঙ্গি নৌকাটা তার অনেক সুসময় আর দুঃসময়ের সঙ্গী। সেদিনের স্বপ্নের পর থেকে ডিঙ্গিটার সাথে তার সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। নৌকা নিয়ে একাকী আনমনে নদীর বুক চষে বেড়ানো আতিকুল বড় উপভোগ করে। কখনো বৈঠা বায় আবার কখনো চিৎ হয়ে আকাশ দেখে। কখনো বা মনের সুুখে গান গায়। আর স্বপ্নকণ্যার ভাবনায় বিভোর হয়। সেদিন আকাশে হালকা মেঘ ছিল। না শীত না গরম। নদীর বুকে বিচরণের ইচ্ছে জাগে আতিকুলের। ডিঙ্গির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আনমনে গুনগুন করতে লাগলো। বেলা বয়ে যায় তার গুনগুনানি থামে না। বাঁধনহারা তরী মৃদু ঢেউয়ে ঢেউয়ে চলে গেল বহুদূর। হঠাৎ, মেয়েলি হাসির শব্দে গান বন্ধ হয় তার। উঠে দাড়ায় সে। যেদিকে তাকায় শুধু নৌকা আর নৌকা। বেদে নৌকা। কিন্তু হাসির শব্দ আসলো কোথা থেকে! হাসিটা যেন তার চেনা। হাসির শব্দ যেন এখনো তার কানে বাজে। দেখতে দেখতে চোখ আটকে যায় কিছু দূরে একটা নৌকায়। গলুইয়ে দাড়ানো একটা মেয়ে। আতিকুলের চোখ চরকগাছ! এ যে সেই মেয়ে যাকে সে এতদিন ধরে খুঁজছে; যার সাথে তার স্বপ্নে দেখা হয়েছিল। কী করবে ভেবে পায় না সে। এত দিন পরে সে তার মনের মানুষকে খুঁজে পেল। অস্থিরতা আর উত্তেজনায় কখন যে আধার নেমে আসে সেটা সে খেয়ালই করে নি। আধারে হারিয়ে যায় মেয়েটা। মন খারাপ হয় আতিকুলের। অসুবিধা নেই সে আবার আসবে এখানে। বারবার আসবে।
আতিকুলের ডিঙ্গি এখন বারবার বেদে পারা অভিমুখে যায়। আজও যাচ্ছে। দ্রুত বেগে যাচ্ছে। আতিকুল এখন আর গুনগুন করে না গলা ছেড়ে গান গায়। গানের গলাটা ভালোই তার। চোখ বন্ধ করে আতিকুল গানের রাজ্যে হারিয়ে গেল। মনের সুখে গান গেয়ে যাচ্ছে সে। আবারও সেই চেনা হাসির শব্দ।
– ভালাই তো গান গাইতে জানো, মাঝি!
চোখ খোলে আতিকুল। তার নৌকার ঠিক পাশেই আরেকটা নৌকা এসে ভিড়েছে। মেয়েটার হাতে নৌকার বৈঠা।
– থামলা ক্যান? গাও, তোমার গান হুইনাই আইছি।
– তুমি হুনবা আমার গান?
– হ, হুনুম। না গাইলে হুনমু কেমনে?
– আইচ্ছা।
আতিকুল যেন স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে গেছে। গলা ছেড়ে রোমান্টিক ধাচের একটা গান ধরে সে। মেয়েটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো একনিবিষ্ট হয়ে সে গান উপভোগ করে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
– কাইল আবার আইবা, মাঝি?
– হ আমু। তুমি কইলে আমু।
– আমি তোমার অপেক্ষায় থাকমু। আইও।
বাড়ি ফেরে আতিকুল। রাত কাটে না তার। দুচোখ জুড়ে শুধু কল্পণা আর কল্পণা। বহুদিনের জমানো আবেগ সদলবলে বিস্ফোরিত হবার পালা। দুপুরের রোদ পড়তে না পড়তেই আতিকুলের ডিঙ্গি পৌছে যায় সেই বেদে পারায়। সেখানে অপেক্ষমান তার স্বপ্নের রানী।
– এতুক্ষণে আইলা। আমি তোমার পথের দিগে চাইয়া রইছি।
কথা শুনে মন ভরে যায় আতিকুলের। যদিও আজ অনেক আগেই এসেছে; তবুও সেটা বিলম্ব বলে মনে হচ্ছে।
– গান হুনবা না!
– না। আইজ তোমার লগে চাইরখান কতা কমু।
– আইচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার নামডা কও না।
– তুমি আমারে একটা নাম দাও না, মাঝি!
আতিকুল যেন স্বপ্ন দেখছে। নাম তো সে ঠিক করেই আছে।
– আইচ্ছা যাও তোমার নাম হইলো স্বর্ণলতা।
মৃদু হাসে মেয়েটা। এই নামে আপত্তি নেই তার।
– হইলো। তোমার নাম কিন্তু আমি জিগাইলাম না। তোমারে আমি মাঝিই বলুম।
আতিকুলের চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্বর্ণলতার দিকে। দেখার সাধ মেটে না। যত দেখে ততই ভাল লাগে।
– আমার দিল দরিয়ায় নাও বাইবা না, মাঝি?
এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। আতিকুলের কল্পণা বাস্তবের সাথে মিলে যাচ্ছে কেমন করে!
– বাইমু, তুমি বাইতে দিবা তো?
– আমার দিল দরিয়া তোমারে দিয়া দিবার চাই। জনমের তরে। তোমার দিলডা আমারে দিবা?
– তুমি লইলে আমি দিমু না ক্যান? লইয়া লও।
হঠাৎ করে ডাক পরে স্বর্ণলতার। মন খারাপ হয় তার। মায়ের গলার আওয়াজ শুনে দ্রুত চলে যায় সে।
– কাইল আইও কিন্তু, মাঝি!
কোনো উত্তর নেই আতিকুলের কাছে। একটা বিশাল রাত কিভাবে পার করবে সে। স্বর্ণলতার ভাবনায় জেগে জেগে রাত ভোর হয়ে যায়। দুচোখ জুড়ে তার রঙিন স্বপ্নের উড়োউড়ি। কত ভাবনা এখন তার মনে! অন্তহীন ভাবনা! কবে সে স্বর্ণলতাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হৃদয়ের স্পন্দন শোনাবে। কবে সে তার ঘরনী হবে। কবে আসবে সে দিন! অপেক্ষা এখন কেবলই অপেক্ষা!
নদীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়ায় নিয়মিত ওরা। অথৈ জলকে সাক্ষী রেখে হাতে হাত রেখে কথা দেয় পরস্পরকে।
– আমারে কথা দাও মাঝি, আমারে কোনোদিন ছাইড়া যাইবা না।
– আমি তোমারে ছাইড়া থাকুম কেমনে! আমি মইরা যামু না!
প্রেমিকার পাশে বসলে সময় মন হয় একটু দ্রুত চলে যায়। ওদের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয় নি। বিকেল গড়িয়ে যে নদীর বুকে কখন আধার নেমে আসে টেরই পায় নি তারা। কেউই ছেড়ে যেতে চায় না পরস্পরকে। এভাবে সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে চায়। আধার ভেদ করে নদীর বুক ঝলমলে হয়ে গেছে চাঁদের আলোয়। আজ পূর্ণিমা। আকাশে ভরা চাঁদ। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। নদীর বুকে যেন সুন্দরের মেলা বসেছে। দূরে জোনাকীর দল আলোর খেলায় মেতেছে। স্বর্ণলতার খুব ইচ্ছে জোনাকীর রঙ দেখার। আতিকুলও সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না। নৌকা চলেছে জোনাকীর দেশে। হাজার হাজার জোনাকী! স্বর্নলতা দু চোখ ভরে দেখছে জোনাকীর খেলা। আতিকুলের চোখ স্বর্ণলতার দিকে। স্বর্নলতার সৌন্দর্যে বিমোহিত সে। চোখের পলক পড়ে না তার। চাঁদের আলোয় স্বর্ণলতাকে অপরূপ লাগছে। এমন রূপ আগে কখনো দেখে নি আতিকুল। তার চোখে চোখ পড়ে স্বর্নলতার।
– কি দেখ, মাঝি?
– তোমারে!
– ক্যান, আমারে কি নতুন দেখ?
– আইজ তোমারে বেশিই সুন্দর লাগে। অসম্ভব সুন্দর!
লজ্জায় লাল হয় স্বর্ণলতা। চোখ নামায় সে। আতিকুল তার হাত দিয়ে স্বর্ণলতার থুতনি স্পর্শ করে।
– আমার দিকে চাও, স্বর্ণ। আমার চোখে চোখ রাইখা দেখ না।
তাকাতে পারে না স্বর্ণলতা। লজ্জায় বিভোর। আতিকুলের বুকে মাথা রাখে সে। আতিকুলও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। এ বাঁধন যেন চিরকাল এরকমই থাকে। স্বর্ণলতার বুকের সব চাপা কষ্ট অশ্রু হয়ে ভিজিয়ে দেয় আতিকুলের বুক। সে অশ্রু পৌঁছে যায় হৃদয় ভেদ করে গহীনের গহীনে। দীর্ঘক্ষণের নিরবতা ভাঙ্গে স্বর্ণলতা।
– একটা কথা কইমু, মাঝি? রাগ হইবা না তো?
– রাগ হইমু ক্যান? তোমার লগে আমি রাগ করবার পারি?
– আইজ হইতে তুমি আমার স্বামী!
কথাটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না আতিকুল। আনন্দের অশ্রু চোখ ভিজিয়ে দেয় তার।
– আর তুমি আমার বউ! আমার প্রাণের বউ! তুমি আমার ভালোবাসা!
আকাশ ভরা তারা, পূর্ণিমার চাঁদ, নদীর ঢেউ আর জোনাকীর দল থাকে সাক্ষী হয়ে। ফুলশয্যায় শোভাপায় কলমি লতা আর তার ফুল।
প্রতিদিনকার মতো আজও আতিকুলের নৌকা এসে দাড়ায় বেদে পাড়ায়। কিন্তু স্বর্ণলতার খবর নেই। দূর থেকে কানে ভেসে আসে কান্না আর চিৎকারের শব্দ। উঠে দাড়ায় আতিকুল। স্বর্ণলতাকে কেউ একজন মারছে আর গালিগালাজ করছে।
– মাগী, পোলা বিয়াইন্নার সময় মনে আছিল না! পোলাডা কান্দে আর তুই ভাতারের লগে ঘুইড়া বাতাস খাইতে মেলা করছোস!
পাশেই চিৎকার করে কাঁদছে একটা বাচ্চা। যা দেখছে ঠিক দেখছে তো! বিশ্বাস হচ্ছে না আতিকুলের। বাচ্চাটা কোলে নেয় স্বর্ণলতা। নিজের স্তন বের করে বাচ্চাটার মুখে দেয় সে। কান্না থেমে যায় তার।
নিজের অজান্তেই নৌকা বেয়ে বেয়ে স্বর্ণলতার কাছাকাছি চলে আসে আতিকুল। দুচোখ ভরা তার অশ্রু। এত বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারল স্বর্ণলতা! মেনে নিতে পারে না সে। স্বর্ণলতার চোখে চোখ পড়ে তার। স্বর্ণলতার চোখেও জলের সমাগম। আতিকুলের তাতে মন টলে না। প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্রোধ তার চোখে মুখে।
– থুঃ! ছিঃ!
ঘৃণাভরা থুতু নিক্ষেপ করে স্বর্ণলতার মুখের উপর। দ্রুত ডিঙ্গি বেয়ে চলে যায় সে।
– আমারে লইয়া যাও, মাঝি। আমি তোমারে ছাড়া বাচুম না। লইয়া যাও।
স্বর্ণলতার কান্না আর চিৎকার আতিকুলের কানে পৌছায় না। স্বর্ণলতার প্রতি এখন তার আর কোনো ভালোবাসা নেই। আছে শুধু ঘৃণা! কেবলই ঘৃণা!
দুই দিন চলে গেল স্বর্ণলতার সাথে দেখা হয় না আতিকুলের। কিন্তু তারা তো কথা দিয়েছিল আজীবন একসাথে থাকবে। তাহলে এখন কেন সে স্বর্ণলতাকে ছেড়ে চলে আসলো। হঠাৎ স্বর্ণলতার প্রতি প্রচন্ড টান অনুভব করে সে। দ্রুত ছুটে যায় ডিঙ্গির কাছে। কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেলেছে আতিকুল।
ডিঙ্গির পাশেই ভাসমান স্বর্ণলতা আতিকুলের দিকে চেয়ে যেন হাসছে। কানে তার কলমি লতার ফুল।
– কইছিলাম না মাঝি তোমারে ছাড়া আমি বাঁচুম না।
লেখকঃ কামরুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ
পিরোজপুর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়