লালমনিরহাট প্রতিনিধি : তিন বছরেও লিজ দেওয়া হয়নি রেলওয়ে লালমনিরহাটের অধীনে চালু হওয়া কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনটির খাবারের গাড়ি।

ফলে তৎকালীন রেলওয়ের ঊচ্চপদস্থ তিনজন কর্মকর্তা বর্তমানে অবসরে গেলেও তারাই চালাচ্ছেন এ গাড়ির খাবারের হোটেল।যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হলেও সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব। যাত্রীদের অভিযোগে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে দুই হাজার ৮০০ কিলোমিটার রেললাইন পরিচালনা করে পূর্ব ও পশ্চিম নামে দু’টি অঞ্চল।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে রেলপথ রয়েছে এক হাজার ৪২৭ কিলোমিটার। এ অঞ্চলের অধীনে দু’টি বিভাগ রয়েছে, লালমনিরহাট পাকশী রেল বিভাগ।বর্তমান বাংলাদেশ রেলওয়ের চারটি বিভাগের মধ্যে লালমনিরহাট অন্যতম। লালমনিরহাট রেল বিভাগের আওতায় প্রতিদিন চলাচল করছে আন্তঃনগর লালমনি এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। এসব আন্তঃনগর ট্রেনে যাত্রীদের জন্য রয়েছে খাবারের হোটেলের ব্যবস্থা। এসব খাবারের গাড়ি বার্ষিক লিজ দিয়েও রাজস্ব আদায় করছে সরকার।

প্রতি বছর রেলওয়ে সব বিভাগের আন্তঃনগর ট্রেনের খাবারের গাড়ি দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দর দাতার নামে বার্ষিক লিজ বরাদ্দ দেয়। কিন্তু ১৮২টি আসনের কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনটির জন্মলগ্ন থেকে খাবারের গাড়ির কোনো দরপত্রই আহ্বান করা হয়নি। রেল বিভাগের নাম করে খাবারের গাড়ি রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তার দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে ডিডি-৩ এর পদ থেকে কালীকান্ত দাস চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এবং সাইদুর রহমান চলতি বছরের অক্টোবরে অবসর নেন। তারা অবসরে গিয়েও রেলে ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ গাড়ির খাবারের মান নিয়েও যাত্রীদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ৫০-৬০ গ্রামের এক টুকরো মুরগির মাংস, একটা সিদ্ধ ডিম, হাফ প্লেট পোলাও, একটি পানির বোতল ও একটি কাঁচা মরিচ দিয়ে নেওয়া হচ্ছে ১৭০ টাকা। যা বাজারে ৯০-১০০ টাকায় মেলে। নাস্তাতেও একই ভাবে গলা কাটা দাম নেওয়ার অভিযোগ যাত্রীদের।

ইকবাল হোসেন নামে একজন যাত্রী বলেন, নিম্নমানের খাবার দিয়েও গলা কাটা দাম নেওয়া হচ্ছে এ ট্রেনে। দুই দিন যাত্রা করতে এ ট্রেনের খাবারে পেটের সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে খেতে হয় যাত্রীদের। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের রংপুরের আলমগরের একটি পরিত্যক্ত বাসার রান্না ঘরে গিয়ে দেখা যায়, পামওয়েল দিয়ে রান্না হচ্ছে যাত্রীদের খাবার। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনটি বড় হওয়ায় খাবারের গাড়ি রয়েছে দু’টি। রান্না হয় রংপুর ও ঢাকায়। সকাল ৭টায় কুড়িগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় এবং সেখান থেকে ফিরে আসে।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মচারী দাবি করেন, ট্রেনটি চালুর দিন রেল ভবনের তিনজন ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি)-৩ কালীকান্ত দাস, সাইদুর রহমান ও এডিজি (অপারেশন) মিয়াজান পরীক্ষামূলক ও রেলের নাম করে নিজেরাই লিজ নিয়েছেন। যার কারণে এ খাবারের গাড়ির কোনো তথ্যই নেই রেল বিভাগে। এ কারণে এ গাড়ির খাবারের মান বা আয় ব্যয়ের খবরও কেউ রাখেন না।

তবে এ ট্রেনের খাবার গাড়ির দায়িত্বে থাকা সৌরভ ঘোষ  বলেন, রেলওয়ের দেওয়া মূল্য তালিকা অনুযায়ী খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। এ ট্রেনের খাবারের গাড়ি রেলওয়ে পরিচালনা করছে। আমরা খাবার পরিবেশনকারীরা রেলওয়ের কর্মী নই। আলাদাভাবে আমাদের মজুরি দেওয়া হয়।

রেলওয়ে লালমনিরহাট বিভাগের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ১ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খাবারের গাড়ি প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দর দাতাকে নির্ধারীত মূল্যে  মানসম্পন্ন খাবার বিক্রির শর্তে লিজ দেওয়া হয়। এ বিভাগের লালমনি এক্সপ্রেস ৯২ হাজার ৪০০ টাকায়, রংপুর এক্সপ্রেস ৯২ হাজার ৪০০ টাকায়, একতা এক্সপ্রেস ৭৯ হাজার ২০০ টাকায়, দ্রুতযান এক্সপ্রেস ৭৯ হাজার ২০০ টাকায় ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ৭৯ হাজার ২০০ টাকায় বার্ষিক লিজ দেওয়া হয়েছে। তবে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের খাবারের গাড়ির কোনো তথ্য বা চিঠি আমাদের কাছে নেই। রেল ভবনই ভালো জানে এ গাড়ির তথ্য।

রেল ভবনের অবসরপ্রাপ্ত ডিডি-৩ কালীকান্ত দাস  বলেন, কারও নামে লিজ নেই কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের খাবারের গাড়ি (বগি)। কুড়িগ্রাম, সুন্দরবন এক্সপ্রেসসহ চারটি ট্রেন রেলওয়ের মার্কেটিং বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি মাঝে মধ্যে সময় দিয়ে সহায়তা করি। যাত্রীসেবাই মূল, খাবার বিক্রি করে আয় করা রেলের কাজ নয়। তবুও আউট সোর্সিংয়ের জনবল দিয়ে খাবার গাড়ি পরিচালিত হচ্ছে। ঊর্ধ্বগতির বাজারে খাবার বিক্রি করে শ্রমিকের বিল পরিশোধ করে কত টাকা আয় হয়? উত্তরাঞ্চলের গাড়িতে বিক্রিও অনেক কম বলেও দাবি করেন তিনি।

লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় ম্যানেজার আব্দুস সালাম  বলেন, সব আন্তঃনগর ট্রেনের খাবারের গাড়ি বার্ষিক লিজ দেওয়া আছে এবং সেখান থেকেও রেলের আয় হচ্ছে। সদ্য যোগদান করায় কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের খাবারের গাড়ির বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, দরপত্র না হলেও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের খাবারের গাড়ি পরীক্ষামূলকভাবে রেলওয়ে পরিচালনা করছে।  অন্যান্য ট্রেনের তুলনায় এটির আয় বাড়ছে জানালেও কত আয় হচ্ছে, সে তথ্য তিনি দিতে পারেননি।নিম্নমানের খাবারের বিষয়ে অভিযান চালানো হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

Share.
Exit mobile version