পলিথিন গলিয়ে তৈরি করা হয়েছে- বঙ্গবন্ধু, মাদার তেঁরেসা, নজরুলু ও শেখ রাসেলসহ বিশিষ্টজনের ভাস্কর্য

খোকন আহম্মেদ হীরা
বাল্যকাল থেকেই ছবি আঁকা, কবিতা ও গান লিখতে ভালবাসতেন এমিলিয়া রায়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় লেখাপড়া থেমে গেলেও থেমে যায়নি তার ইচ্ছা শক্তি। স্বামীর সংসারে এসে নিজের অদম্য ইচ্ছায় আবারও শুরু করেন ছবি আঁকা, কবিতা ও গান লেখা।
নানাগুনের অধিকারী এমিলিয়া রায় নিজের কল্পনা আর ইচ্ছা শক্তির জোরে স্বল্প খরচে সৃষ্টিশীল কিছু করার চেষ্টা করেন। আর তাই তিনি বেঁছে নিয়েছেন পরিবারের ফেলে দেয়া অপ্রয়োজনীয় পলিথিন। বিভিন্নজনের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে রান্নার চুলোয় গলিয়ে শুরু করেন ভাস্কর্য তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে তিনি তৈরি করেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর্তমানবতার সেবক মহীয়সী নারী মাদার তেঁরেসা। বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীত নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক ও বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বমানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ট পুত্র শেখ রাসেলসহ ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় একশ’ ভাস্কর্য।
শারীরিক অসুস্থতায় হাঁটাচলা করতে ও কথা বলতে কষ্ট হলেও মনের মাধুরি মিশিয়ে এমিলিয়া রায় তৈরি করে যাচ্ছেন তার শিল্পকর্মের কাজ। আর তার অভিনব সৃষ্টি দেখতে বাড়িতে প্রতিদিন ভীড় করছেন নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ।

 

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের রাহুতপাড়া গ্রামের আলফ্রেড রায়ের স্ত্রী পাঁচ সন্তানের জননী ৭০ বছরের বৃদ্ধা এমিলিয়া রায় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে শেষ ইচ্ছা পোষন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর শর্তবর্ষে তার নিজ হাতের তৈরী এসব ভাস্কর্য তুলে দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। দাম্পত্য জীবনে দুই পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জননী এমিলিয়া রায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েদের দেখ ভালের সকল দ্বায়িত্ব পরে এমিলিয়া রায়ের উপর।

 

আগৈলঝাড়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তপন বসু বলেন, নিছখ শখ থেকে শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম তৈরীর মাধ্যমে সুনাম, খ্যাতি অর্জনের সাথে সাথে নিজেদের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখেন। শিল্পকর্ম তৈরী ও তা প্রদর্শনের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করেছেন দেশ-বিদেশের অনেক গুণী শিল্পী। আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের রাহুতপাড়া গ্রামের এমিলিয়া রায় তেমননি একজন গুণী শিল্পী।
তিনি আরও বলেন, প্রচার বিমুখ এই গুণী শিল্পী জঞ্জালমুক্ত পরিবেশ দুষণকারী পরিত্যক্ত পলিথিন দিয়ে তৈরী করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেবাদানের পথিকৃৎ মাদার তেঁরেসা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শেখ রাসেলসহ বিশিষ্টজনের শতাধিক ভাস্কর্য। ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করা শিল্পী এমিলিয়া রায়ের শেষ ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তার পরম যতেœ নির্মান করা ভাস্কর্যগুলো তুলে দেয়া।

ভাস্কর্য শিল্পী এমিলিয়া রায় বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, গান গাওয়া ও নিজের লেখা গানে কন্ঠ দেয়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিলো। এসএসসি পাশ করার পরেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। সংসার জীবনে প্রবেশ করে লেখাপড়া থেমে গেলেও থেমে যায়নি আমার উদ্ভাবনী ইচ্ছা শক্তি। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসেও নতুন করে আমি ছাত্রজীবনের সেই উদ্ভাবনীর কাজ শুরু করি।

 

তিনি আরও বলেন, ১৯৯০ সালের কোন একদিন রান্না করা গরম কড়াই পাশের পলিথিন ব্যাগের উপর রাখায় পলিথিন ব্যাগ গলতে দেখে ওই পলিথিনের মাধ্যমেই নতুন করে উদ্ভাবনীর ইচ্ছে কড়ানাড়ে আমার মনে। সেদিন থেকে পরিবারের ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগ বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা আগুনে পুড়িয়ে শুরু করি ভাস্কর্য নির্মানের কাজ।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, পরম যন্তে এমিলি রায় নির্মান করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, প্রায় ৮০ কেজি ওজনের মাদার তেঁরেসার ভাস্কর্য। শিল্প দক্ষতা আর নিপুনতার ছোয়ায় পর্যায়ক্রমে তিনি নির্মান করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। পাশাপাশি এমিলি রায় তার রাজনৈতিক দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নির্মান করেছেন বিশ্ব মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাস্কর্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার সাথে ঘাতকের বুলেটের সামনে প্রাণপন বাঁচার আকুতি জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শেখ রাসেলের ভাস্কর্য। নির্মান করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়া পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসরদের মাধ্যমে নির্যাতনের ঐতিহাসিক ভাস্কর্য। ছোট-বড় সবমিলিয়ে শতাধিক ভাস্কর্য রয়েছে তার নিজের সংগ্রহ শালায়। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক অসুস্থতায় হাঁটা চলায় সমস্যা হলেও থেমে নেই তার (এমিলিয়া রায়) শিল্পকর্ম নির্মাণের কাজ। নিরলসভাবে নির্মাণ করে চলেছেন ভাস্কর্য।

 

শুধু পরিবেশ বিরুপ পলিথিন দিয়ে ভাস্কর্য নির্মানই নয়; গুনী শিল্পী এমিলিয়া রায় তুলা দিয়ে আঁকা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিষীকাময় দৃশ্যগুলো। এছাড়াও মানুষের মাথার চুল সংগ্রহ করে তা দিয়ে নির্মান করেছেন বঙ্গবন্ধুর মুখ মন্ডল সম্বলিত অপরূপ বাংলাদেশের মানচিত্র।

 

শিল্পী এমিলিয়া রায় আরও বলেন, শেষ জীবনে তার ইচ্ছা; নিজের হাতে তৈরী করা ভাস্কর্যগুলো মমতাময়ী মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু সকল ভাস্কর্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ঘাতকের বুলেটে নির্মম হত্যার শিকার হওয়ার আগে শেখ রাসেলের বাঁচার আকুতিভরা নিপুন ভাস্কর্যটি নিজের কাছেই রাখতে চান এমিলিয়া। কারণ হিসেবে তিনি  বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার তিন বছরের পুত্র তিনু রায় গুরুত্বর অসুস্থ্য হয়ে বিনাচিকিৎসায় চোখের সামনে ধুকে ধুকে মারা যায়। শেখ রাসেলের আকুতিভরা ভাস্কর্যর মাধ্যমে তিনি নিজের হারানো পুত্র তিনু রায়কে খুঁজে পান।
এমিলিয়া রায়ের কন্যা তরুন উদ্যোক্তা ভাস্কর্য শিল্পী আইরিন রায় জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার মায়ের এই বিচিত্র আবিস্কারকে বাঁচিয়ে রাখা গেলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শর্তবর্ষে এসে দেশে নতুন এক সম্ভাবনার দার খুলবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 

আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত  বলেন, এমিলিয়া রায়ের এ দূর্লভ সৃষ্টি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হয়না কতোটা অসাধারন। সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার এ সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আর এ সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষনের হাত থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি অসংখ্য বেকার-যুবকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এমিলিয়া রায়ের জীবনের শেষ ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর শর্তবর্ষে এসব দুর্লভ ভাস্কর্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সার্বিক সহায়তা করবে এমনটাই আশা করছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত।

 

এমিলিয়া রায়ের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান  বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব শিল্পকর্ম তুলে দেয়ার ব্যাপারে আবেদন করলে উর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Share.
Exit mobile version