*খনন, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধণে আড়াই
হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে
প্রেরণ
বরিশাল অফিস:- ধান-নদী-খালের ঐতিহ্যবাহী বরিশাল শহরের মাঝে বয়ে গেছে ২২টি ছোট-বড় খাল। যার বেশিরভাগই এখন নগরবাসীর বাসা-বাড়ির সুয়ারেজ লাইনের পানি কিংবা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব খাল দিয়ে একসময় যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করলেও দীর্ঘদিন ধরে খননের অভাব ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নাব্যসংকটের পাশাপাশি প্রশস্ততা কমে এসব খাল এখন নালায় পরিনত হয়েছে। ফলে ভারি বৃষ্টি হলে নগরজুড়ে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নগরীর পোর্ট রোড থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত বয়ে চলা জেলখালটি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার ও পরিচ্ছন্নতা করার কাজ শুরু করা হয়। ‘জনগণের জেল খাল, আমাদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ শ্লোগানে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নগরীর হাজারো মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে খালটি পরিস্কার করেছিলো। তৎকালীন জেলা প্রশাসক গাজী মোঃ সাইফুজ্জামানের উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন অভিযানের আগে খালের দুই তীরের অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়েছিলো।
ওই সময় শুধু জেল খাল-ই নয়, স্বেচ্ছাসেবক ও নগরবাসীর স্বতস্ফুর্ত উদ্যোগে শহরের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া সাগরদী, চাঁদমারী, নাপিত খালী, লাকুটিয়া, নবগ্রাম, ভাটার, আমানতগঞ্জ, টিয়াখালী, কাশিপুর, কলাডেমা ও শোভারানী খালসহ ২২টি খালের অস্তিত্ব উদ্ধারে কাজ শুরু করা হয়েছিল।
এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খালগুলোর বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হয়েছিল খালের নামসহ সাইনবোর্ড। পাশাপাশি ওইসময় প্রতিটি খালই পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল। এসব খালের বেশির ভাগেরই মালিকানা জেলা পরিষদ। তবে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে জেলা প্রশাসনকে সহায়তা করেছিলো সিটি কর্পোরেশন। পরবর্তীতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক গাজী মোঃ সাইফুজ্জামানের আকস্মিক বদলীর ফলে থমকে যায় খাল খননের উদ্যোগ। এরপর আবারও এসব খাল ফের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের শেষেরদিকে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামে সিটি কর্পোরেশন। ওইসময় এসব খালে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
এ ব্যাপারে সনাকের জেলা সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, বরিশালের খালগুলো যেভাবে পরিস্কার করা হচ্ছে, তাতে শুধু ওপর থেকেই পরিস্কার মনে হয়। কিন্তু খনন না করায় খালের নিচে বেশ পুরু একটা ময়লা-আবর্জনার স্তর পরেছে। ফলে নতুন করে ময়লা ফেলার কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই খাল ভরাট হয়ে যায়। এসব খাল রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, নগরীর প্রতিটি খাল আলাদা ঐতিহ্য বহন করে। তিনবছর আগে জেল খাল যখন দখলমুক্ত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়, তখন খালের তীরের বাসিন্দাদের ময়লা না ফেলার জন্য বলা হলেও তা কেউ মানেননি। তাই জেল খাল এখন সেই আগের মতোই হয়ে গেছে। একইসাথে বসে নেই দখলদাররাও।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শহরে ছোট বেলায় বটতলা বাজার, বাংলা বাজার, সাগরদী বাজার, চৌমাথা-নতুন বাজারসহ বেশিরভাগ বাজারের পেছন বা সামনের খালের ঘাটে নৌকা ভিড়তো। মাছসহ বিভিন্ন সামগ্রী সেসব নৌকায় বাজারে আনা হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব খালে পানি প্রবাহ ঠিকই হচ্ছে কিন্তু নৌকা চলার কোনো উপায় নেই। আর বাংলা বাজারের পেছনে ও বটতলা বাজারের সামনে খালের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা আরও বলেন, কীর্তনখোলা নদীর সাথে সংযোগ থাকা ভাটারখালও এখন অস্তিত্ব সংকটে। চাঁদমারি খালও জেলা প্রশাসকের বাংলো বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে এসে শেষ হয়ে গেছে, এরপর আর সেই খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সরেজমিনে চাঁদমারী খালের স্টেডিয়াম পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে বহু দোকান নির্মান করায় খালের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
সূত্রমতে, নগরীর ত্রিশ গোডাউন হয়ে বধ্যভূমির পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সাগরদী খাল। প্রবহমান এ খালটির আলেকান্দা-কাজিপাড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটারে এখনও জোয়ারের পানি আসে। তবে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিরাবাড়ি-চৌমাথা বাজার থেকে পশ্চিমে পপুলার বিদ্যালয় পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হয়ে গেছে খালের পানির প্রবাহ।
বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, খালগুলো নগরীর পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ। এগুলো বাঁচানো গেলে বরিশাল প্রকৃত অর্থেই প্রাচ্যের ভেনিস হতো। খালগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ায় পানির উৎসও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, যেকোনো উপায়ে নগরীর খালগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন। বেলা ২০১০ সালে জেলখাল ডিমার্কেশন ও সংরক্ষণের জন্য একটি মামলাও করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খালের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি। পরিবেশবিদ রফিকুল আলম বলেন, খালগুলোকে পূর্বেরস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে সামাজিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। যারা এগুলোর দখল-দূষণ করছে তাদের সচেতন করতে হলে সামাজিক সমন্বয় প্রয়োজন, কারণ তারা সবাই রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীর খালগুলো খনন, তীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গত এক মাস পূর্বে এর প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, খালগুলো খনন, তীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য একটি বড় প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে সাবমিট করা হয়েছে। খালগুলো যথানিয়মে পরিস্কার করতে পারলে নগরীতে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, শহরের খাল নিয়ে আমরা যেভাবে পরিকল্পনা করেছি তাতে বরিশাল শহরের চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।