*এসএম অজিয়র রহমান*
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার যা ব্যতীত ব্যাক্তির, সমাজের ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব। একসময় আমরা নিন্ম-মধ্যম আয়ের স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম। তা থেকে শিক্ষাসহ সকল সূচকে আমাদের অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ কারণে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ পেরিয়ে ২০৪১ সালে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব।
সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ঝরেপড়া একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ হওয়ার পূর্বে যেকোন সময় যেকোন শ্রেণি থেকে বিদ্যালয় ত্যাগ করে লেখাপড়া ছেড়ে দিলে তাকে প্রাথমিকস্তরে ঝরে পড়া বলে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭ টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৬.৪৮%। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছে। ব্যানবেইজের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ২৫ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এরমধ্যে ‘‘এ’’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নবজাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন-রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরীক্ষণ বিদ্যালয়, কমিউনিটি বিদ্যালয়, রিচিংআউট-অফ-স্কুল চিলড্রেন স্কুল (জঙঝঈ), শিশু কল্যাণ বিদ্যালয়। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে-এবতেদায়ী মাদ্রাসাসহ তিন ধরনের স্কুল। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন ও চা বাগান স্কুল। ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে মসজিদ/মন্দির ভিত্তিক, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল, জেল সংযুক্ত স্কুল ও কওমী মাদ্রাসাসহ নয় ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘ই’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে এনজিও পরিচালিত তিন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠপদ্ধতি, কারিকুলাম ও অবকাঠামোগত পার্থক্য থাকায় এর প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর। ফলে, তারা ঝরে পড়ছে স্বাভাবিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে।
ঝরে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিশুর যতেœর ঘাটতি, মেয়ে শিশুকে শিক্ষা না দেয়ার প্রবণতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, ভাষার সমস্যা, বিদ্যালয় ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, দুর্বল শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষাক্রমের অসংগতি, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত দুর্বলতা, অপ্রতুল সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম, বিদ্যালয়ের দূরত্ব, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়হীনতা, অনিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ঝরে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল দারিদ্র। দরিদ্র পিতা-মাতা সংসারের খরচ যোগানোর জন্য সন্তানদের স্কুলের পরিবর্তে কাজে প্রেরণ করেন। ধীরে ধীরে তারা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে রুপালী ব্যাংক শিওর ক্যাশের মাধ্যমে। যা অভিভাবকদের মোবাইল ফোনের একাউন্টে সরাসরি জমা হয়। উপবৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে মোট পাঠ দিবসের শতকরা ৮৫ দিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয় এবং পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। উপবৃত্তি ঝরে পড়া রোধে একটি অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে প্রমানিত হয়েছে।
ঝরে পড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ অভিভাকদের অসচেতনতা। দরিদ্র ও অশিক্ষিত পিতা-মাতা অজ্ঞতার কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাননা। এটা অনেকটাই নিরসন করা যাচ্ছে মা অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভা কিংবা হোম ভিজিটের মাধ্যমে। এগুলো যত বেশি বেশি করা যাবে অভিভাবকগনের সচেতনতা ততই বৃদ্ধি পাবে।
এরপরের যে কারণটি রয়েছে তা হল শিশুশ্রম। এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি যা শিশুদের অল্প বয়সেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। শিশুরা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন মৌসুমী কাজে জড়িয়ে পরে। কোন কোন অঞ্চলে শিশুরা মাছ ধরতে জেলের পেশা কিংবা ইট ভাটায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তারা ইট ভাটায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রি হয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও ধান, সয়াবিন, বাদামসহ মৌসুমী শস্য ক্ষেতে কাজ করতে চলে যায়। সরেজমিনে পরিদর্শনে এই সকল চিত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং অতিলোভ চরমভাবে দায়ী। শিশু শ্রম প্রতিরোধে ইতোমধ্যে শিশুশ্রম নিরোধ আইন ও জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। যা শিশু শ্রম ও ঝরে পড়ারোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ঝরে পড়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের প্রবণতা থেকে এখনও দুর্গম অঞ্চলগুলো মুক্ত হতে পারেনি। সরকারের কঠিন বিধি নিষেধ সত্বেও অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের (বিশেষ করে কন্যা সন্তান) প্রশাসনের অগোচরে গোপনে আইনে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বিয়ে দেন। ফলে মেয়ে শিশুদের ঝরে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। তথাপি, প্রশাসনের শক্ত নজরদারি ও প্রতিরোধের কারণে বাল্যবিবাহ এখন ব্যাপকভাবে কমে এসেছে। ফলশ্রæতিতে ঝরে পড়ার হারও হ্রাস পাচ্ছে।
ঝরে পড়ারোধে সরকার আরও যেসকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তারমধ্যে রয়েছে-বছরের শুরুতে প্রতিটি স্কুলে ক্যাচমেন্ট এলাকা ভিত্তিক শিশু জরিপ পূর্বক ভর্তি নিশ্চিত করা, নিয়মিত মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিট কার্যক্রম, বছরের প্রথমদিন শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ, মিড ডে মিল চালুকরণ, একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম চালুকরণ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুকরণ ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহকরণ, স্থানীয় জনগণকে বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং আনন্দস্কুল প্রতিষ্ঠা করা।
এছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের অন্যতম দিক হলো-বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। লেখাপড়ার মাঝে খেলা ও ছবি আঁকার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে পাঠদান করানো হচ্ছে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা পড়ার মাঝে বিনোদন খুঁজে পায়। আর এ ধারণা থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সাভারে পরিচালনা করছে খেলা ও আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার কার্যক্রমের। এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘‘শিখবে প্রতিটি শিশু’’। দেশের ১৩টি উপজেলায় ১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে এ শিক্ষাব্যবস্থা। আন্তরিকতার সাথে কাজ করে এ সকল কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলেই ঝরে পড়া বন্ধ হবে; অর্জিত হবে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যাশিত শতভাগ সাক্ষরতার হার।
বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য মানসম্মত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আর এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাই হবে একজন শিশুর সম্ভাবনা বিকাশের মূল ভিত্তি। শিশুর শিক্ষার সে ভিত্তিকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া প্রতিরোধ করতে হবে। ঝরে পড়ার হার শতভাগে উন্নীত করা সম্ভব হলে আমাদের স্বাক্ষরতার হার আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। এটি বাস্তবে পরিণত হোক তা আমাদের সকলেরই প্রত্যাশা। বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের “সোনার বাংলা” তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রæত “উন্নত বাংলাদেশ” বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ারোধ করার বিকল্প নেই।
-লেখক: জেলা প্রশাসক, বরিশাল।