দৃশ্য ১: দিব্যি বসে খাচ্ছিলো ছানা। হঠাৎ ‘খক খক খক’ করে এমন কাশি যে চোখে জল বেরিয়ে গেলো। কী হল, কী হল করে অস্থির হয়ে গেলো মা।
দৃশ্য ২: যা পাবো তাই কুড়িয়ে খাবো, এরকম একটা ভাবধারা নিয়েই চলে আপনার বাচ্চা। কিছু না পেলে নিজের জামা ধরেও টানাটানি করে। এরকম ভাবেই জামা থেকে একটা বোতাম ছিঁড়ে গিলে ফেললো! কাঁদতে গিয়েই নিস্তেজ হয়ে যেতে শুরু করলো!
কতটা বিপজ্জনক এই গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে যাওয়া; এটা তো আর বলারই অপেক্ষা রাখে না। মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে যেতে পারে মারাত্মক বিপদ! (How To Save Baby When Something Stuck in Throat) তবে, ঘটনার কারণ এবং গুরুত্ব জানা থাকলে পরিস্থিতি অনেকসময়ই হাতের বাইরে যায় না। কিছু জীবনদায়ী চিকিৎসা শুরু হয়ে যেতে পারে বাড়িতেই!
যতই সাবধানে রাখুন, বাচ্চার গলায় খাবার আটকানো আপনি আটকাতে পারবেন না। যেটুকু করতে পারেন, তা হল সতর্ক থাকা আর বাচ্চার গলায় কিছু আটকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কী ব্যবস্থা নেবেন; সেগুলো অবগত থাকা।
আজকের প্রতিবেদন তাই বাচ্চার গলায় খাবার বা কোনও কিছু আটকে যাওয়া নিয়েই। কী করে গলায় লাগে, কী করবেন, প্রাথমিকভাবে কী চিকিৎসা করবেন বা ডাক্তারের কাছে কখন নিয়ে যাবেন; বিস্তারিত বিবরণ রইল এখানেই! জানতে হলে পড়ে নিন এখনই।
#1. গলায় আটকে যাওয়া ব্যাপারটা আসলে কী?
আমরা যেমনটা বারবার বলি, কোনও ঘটনার পিছনে তার সম্যক কারণ জানা থাকলে অনেকক্ষেত্রেই কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। অকারণে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় না এবং অবস্থার গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাই, “গলায় খাবার আটকাতেই পারে” বা “এতো আকছার হয়” এরকম কোনও বক্তব্য না দিয়ে আমরা কারণটাও খোঁজার চেষ্টা করি নাহয়!
- আমাদের গলার ভিতর খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী পাশাপাশি থাকে। যখন আমরা খাবার খাই, তখন স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই আমাদের শ্বাসনালীর ওপরের অংশ ঢাকা পড়ে যায়। এবার খাওয়ার সময় উত্তেজিত হয়ে পড়লে, কথা বললে বা তাড়াহুড়ো করে না চিবিয়ে গিলতে গেলে সেই খাবারের কিছু অংশ শ্বাসনালীতে ঢুকে যায়। তখনই “বিষম” বা চলতি কথায় “সটকা” লাগে।
- উদাহরণ দিই? কখনও খেয়াল করে দেখেছেন, জল খেতে গিয়েও বিষম লাগে। বড়দেরও এই বিষম লাগে এবং সেই সময় কাশি উঠলে নাকের মধ্যে জল উঠে এসেছে; এরকম অনুভূতি হয়; শ্বাসনালীতে জল ঢুকে যাওয়ার দরুনই এমনটা হয়।
- শ্বাসনালীতে খাবার আটকে গেলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
- আবার মাছের কাঁটা বা অন্য কোনও ছোট খাবার পুরো গিলে নিলে তা আটকে যায় খাদ্যনালীতেই। গলার মাংস খুব নরম হয় বলে মাছের কাঁটা ফুটে গিয়ে খচখচ করতে থাকে। আবার ধরুন বাচ্চা মার্বেল গিলে ফেললো বা আস্ত লিচু একবারে গিলে নিল; সেক্ষেত্রেও খাদ্যনালীতে খাবার মাঝখানে আটকে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে খাদ্যনালীও।
#2. ছোট্ট বাচ্চার গলায় খাবার বা ছোট্ট কোনও জিনিস কীভাবে আটকে যেতে পারে?
বাচ্চার গলায় খাবার বা অন্য যে কোনও কিছু আটকানোর কোনও নির্দিষ্ট কারণই নেই। মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে যেতে পারে বিপদ। তাও সম্ভাব্য কারণগুলি সাজিয়ে দিলাম পয়েন্ট করে;
- একদম ছোট্ট বাচ্চা বা নবজাতক; ব্রেস্ট মিল্ক খেতে গিয়ে তার গলাতেও আটকাতে পারে।
- বাচ্চা নতুন নতুন সলিড খাবার খাওয়া শুরু করলে, মাঝেসাঝে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- বাচ্চাদের একটা অদ্ভুত প্রবণতা থাকে, যা পায় তাই কুড়িয়ে মুখে দেওয়া। তা সে হতে পারে খেলনার কোনও অংশ, মাটিতে পড়ে থাকা কয়েন বা শুকনো ফলের বীজ, পেনের ঢাকনা, খেলনা মারবেল, আঙুর
- লিচু/বেদানা/কুল/ চীনাবাদাম জাতীয় ছোট্ট আকারের খাবার ইত্যাদি। এবার বাবা-মায়ের ক্ষণিকের অসাবধানতায় শিশু যদি এগুলোর কোনওটা গিলে ফেলে, সেটা তার গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
- খেতে খেতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে গেলে বা হাসতে গেলে বা হঠাৎ হাঁচি/কাশি পেলেও বাচ্চার গলায় খাবার আটকে যেতে পারে।
- আর একটা যেটা না বললেই নয় এবং খুব সাধারণ ঘটনা। তা হল, গলায় মাছের কাঁটা আটকে যাওয়া। ছোট্ট কাঁটা বেছে নিজে খেতে যাক বা মা খাইয়ে দিক; হতেই পারে চোখ এড়িয়ে কাঁটা থেকে গেলো মাছে। শুধু বাচ্চা নয়, আমাদের বড়দের সাথেও এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তাই না?
#3. বাচ্চার গলায় খাবারের টুকরো বা অন্য কোনও জিনিস আটকে গেছে কি না কীভাবে বুঝবেন (How to Tell If Something is Stuck in Baby’s Throat)?
আপনি হয়তো বাচ্চার সামনে নেই, কিছুক্ষণ পরে এসে তাকে কাঁদতে দেখলেন বা অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখলেন। কী দেখে বুঝবেন যে বাচ্চা কিছু গিলে ফেলেছে বা ওর গলায় কিছু আটকে গেছে? (How to Tell If Something is Stuck in Baby Throat)
- বাচ্চা কাঁদবে, ওর কাঁদার ধরন দেখে বুঝবেন যে ওর কাঁদতেও অসুবিধা হচ্ছে। তবে, ভালো খবর যে বাচ্চা কাঁদছে মানে ও শ্বাস নিতে পারছে। অস্বস্তিতে কাঁদছে।
- বাচ্চা হঠাৎ বিষম খেলে বুঝবেন ও কোনও কিছু নিয়ে খেলছিল তার অংশ মুখে নিয়ে গিলে ফেলেছে।
- বাচ্চা যদি নেতিয়ে পড়ে, একবিন্দু সময় নষ্ট না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
- বাচ্চা একটু বড় হলে সে নিজেই গলার দিকে দেখিয়ে তার অস্বস্তির কথা জানাবে। গুরুত্ব বুঝে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিন।
- বাচ্চার মুখ থেকে বেশি পরিমাণে লালাও বেরোতে পারে এসময়।
আরও পড়ুন: ছোট্ট সোনার কানে পোকা ঢুকে গিয়েছে? এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন কীভাবে?
#4. বাচ্চার গলায় কিছু আটকে গেলে তৎক্ষণাৎ যে কাজগুলো আপনি করতে পারবেন (What to Do if Food is Stuck in Your Babies’ Throat?)
একদম ছোট্ট বাচ্চা বা ২-৩ বছর বয়স:
- বাচ্চাকে উল্টে নিজের বাম হাতের ওপর শোওয়ান।
- পিঠের দিকটা একটু উঁচু হয়ে থাকবে এবং মুখের দিকটা নীচে। (Something Stuck in Throat How to Get it Out)
- এবার আপনার ডান হাতের তালু দিয়ে বাচ্চার পিঠের ওপরের অংশে কাঁধের কাছে আস্তে আস্তে চাপড় মারুন। এতে মুখ দিয়ে গলায় আটকে যাওয়া খাবার বেরিয়ে আসবে।
- আরেক পদ্ধতি হল, বাচ্চাকে সোজা করে অর্থাৎ চিত করে শুইয়ে দিন। বাচ্চার বুকের মাঝখান থেকে মালিশ করুন নীচ থেকে ওপর দিকে। অর্থাৎ মালিশের পদ্ধতি হবে বুক থেকে মুখের দিকে। এর ফলে, বাচ্চার ওপরের অংশে একটা চাপ সৃষ্টি হবে।
- এটা করার পরেই আগের পদ্ধতিতে বাচ্চাকে হাতের ওপর উল্টে নিয়ে পিঠে চাপড় দিন। বাচ্চার মুখ দিয়ে খাবারের টুকরো বেরিয়ে আসতে পারে।
- একদম ছোট্ট বাচ্চার ওপরে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন তাৎক্ষনিক মোকাবিলায়। ৩-৪ বার চাপড় দিলেও যদি খাবার না আসে বা বাচ্চা না কাঁদে; ডাক্তারের কাছে যান সঙ্গে সঙ্গে।
একটু বড় বাচ্চার ক্ষেত্রে:
- যদি গলায় মাছের কাঁটা আটকে যায়; সেক্ষেত্রে শুকনো ভাত, মুড়ি বা চটকানো পাকা কলা একটু গিলে ফেলতে বলুন। কাঁটা নেমে যাবে। ৩/৪ বারেই নেমে যাবে মাছের কাঁটা। (What to Do if Food is Stuck in Your Babies’ Throat)
- হাল্কা গরম জলে একটু নুন মিশিয়ে বাচ্চাকে গিলে নিতে বলুন। এতে কাঁটা নরম হয়ে গলে নেমে যায়। মাছের কাঁটা গলায় ঢুকলে কী করবেন, সে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমাদের এই প্রতিবেদনটি-> চটজলদি গলার কাঁটা নামাবেন কী করে?
- বাচ্চা মার্বেল, কয়েন জাতীয় কিছু গিলে ফেললে ওর পিঠে জোরে জোরে চাপড় দিন। এর ফলে কাশি উঠে গলায় আটকে থাকা জিনিস বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।
হতে পারে বাচ্চা পেনের ঢাকনা গিলে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে ঢাকনার ওপর দিকটা হয়তো আপনি দেখতে পেলেন। অত্যন্ত সাবধান হয়ে আস্তে করে সেটা বার করে নিন। যদি দেখতে না পান, খবরদার খোঁচাখুঁচি করবেন না; হয়তো বেরিয়ে আসার বদলে আরও ভিতরে চলে গেলো! - আরেকটি পদ্ধতি বলতে পারি, তবে এটা করবেন বড় শিশুর ক্ষেত্রেই। বাচ্চার পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ুন। এবার পিছনদিক দিয়ে ওর বগলের তলা দিয়ে আপনার দুই হাত ঢুকিয়ে সামনে নিয়ে আসুন। ওর পেটের ওপরের দিকে, যেখানে পাঁজর শেষ হয়েছে সেখানে আপনার দুই হাত রাখুন। এবার নিজের একহাত মুঠো করে নিন এবং অন্যহাত দিয়ে মুঠো হাতের কবজিটা চেপে ধরুন। বাচ্চার পেটে ৪/৫ বার জোরে চাপ দিন। এতে কাজ না হলে সত্বর ডাক্তারের কাছে যান।
- বিপদ এড়াতে শিখে রাখুন মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং পদ্ধতি। এতে বাচ্চার শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না। (How To Save Baby When Something Stuck in Throat)
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs):
#1. বাচ্চা সবকিছু মুখে দেয়, কীভাবে সতর্ক হবো? (What safety precautions can I take?)
- বাচ্চার সামনে পুঁতি বসানো কোনও খেলনা বা সহজেই টুকরো হয়ে আসে এমন খেলনা, খেলনা ক্লে, কয়েন, টুথপিক, কোনও ঢাকনা জাতীয় জিনিস রাখবেন না।
- বাচ্চাকে এমন জামা পরাবেন না, যাতে বোতাম আছে। বাচ্চা বোতাম টেনে ছিঁড়ে মুখে ভরতেই পারে।
- বাচ্চা যদি সবে খেতে শিখেছে, তা হলে ওকে আঙুর, বেদানা বা লিচুর মতো ফল হাতে ধরে দেবেন না। খেতে বসিয়ে দেবেন না একা একা।
- বাচ্চা অনেক সময় নিয়ে খাচ্ছে বলে মুখে খাবার ঠুসে দিলেন অনেকটা, বিপদ তাতে বেড়ে যাবে আপনারই। মুখে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার গেলে বাচ্চার গলায় লাগতেই পারে।
- একদম সদ্যোজাত বাচ্চার ক্ষেত্রে বা ছোট্ট বাচ্চার ক্ষেত্রে শুয়ে দুধ খাওয়াবেন না। মাঝেই মাঝেই দেখে নেবেন বাচ্চা ঠিকভাবে খেতে পারছে কি না। বেকায়দায় স্তন যদি বাচ্চার মুখের ওপর চাপা পড়ে, অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চা বিষম খায়।
#2. বাড়িতে সারাদিন আমি থাকি না, এমারজেন্সি অবস্থা সামলাতে কী করতে পারি?
মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং পদ্ধতি যেমন নিজে শিখবেন তেমনই শিখিয়ে দেবেন বাচ্চার আয়ামাসিকেও। বাচ্চার কোনও বিপদ ঘটলে হাসপাতালে পৌঁছনো পর্যন্ত বাচ্চার শরীরে অক্সিজেন জোগান যাবে এভাবেই।
বারবার বলছি, বাচ্চার ক্ষেত্রে কোনও রিস্ক নেবেন না। প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া উপায় ট্রাই করে যদি বাচ্চা আরাম না পায়, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। (How To Save Baby When Something Stuck in Throat).