রাঙাপ্রভাত অনলাইন ডেস্কঃ বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের ব্যাপক সমরসজ্জা করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে সিটওয়ে নৌ ঘাঁটিতে সাবমেরিন, আন ও সিটওয়ে বিমান ঘাঁটিতে সু৩০, মিগ ২৯ ও জেএস ১৭ থান্ডার্ড ব্লক-২ জঙ্গিবিমান নিয়ে আসার খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরে উত্তর কোরিয়া থেকে সংগ্রহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। পাঁচ দিন ধরে এ সমরসজ্জা চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বিবিসি খবর প্রকাশ করার পর বিভিন্ন সূত্র থেকে বিস্তারিত তথ্য আসতে শুরু করেছে।
এ দিকে তমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার সেনা চৌকি বাড়ানোয় এপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিজিবিও টহল জোরদার করেছে। কক্সবাজারের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের ওপারে হঠাৎ ভারী অস্ত্র ও অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করার খবর আসে। সীমান্তের বাইশফাঁড়ি এলাকাসহ আশপাশে নতুন করে সবুজ রঙের তাঁবু টাঙ্গিয়ে অস্থায়ী চৌকি স্থাপন করেছে সেনারা। মিয়ানমারের এ ধরনের উসকানিমূলক আচরণে শূন্যরেখায় অবস্থানরত হাজার হাজার রোহিঙ্গা এবং সীমান্তের এপারের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার-৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের টহলসহ কার্যক্রম আরো জোরদার করেছি। আর সীমান্তে সবাইকে সতর্ক অবস্থানে রেখেছি। এ ব্যাপারে নতুন অনুপ্রবেশসহ কোনো ঘটনা ঘটলে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। ওদের এলাকায় সন্দেহজনক গতিবিধিসহ সেনাদের উপস্থিতি আছে, সেটি জেনেছি।’
টেকনাফ-২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: ফয়সল হাসান খান বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেনা সমাবেশ ও তাদের সন্দেহজনক গতিবিধির কথা জেনেছি। সীমান্তে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’
জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে স্বাভাবিক যে সেনা শক্তি রয়েছে তা বাড়িয়ে জনবল ৪৩ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, রাখাইনের দুই বিমান ঘাঁটিতে ৬টি মিগ ২৯, ৪টি জেএস ১৭ থান্ডার্ড ব্লক টু জঙ্গিবিমান আনা হয়েছে। ভারত থেকে সংগৃহীত একমাত্র সাবমেরিনও সিটওয়ে উপকূলে এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র অনুসারে, মিয়ানমার ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সংগ্রহ করে। এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও রাখাইনে নিয়ে আসা হয়েছে। এর বাইরে ৫টি নেভি গানবোট আনা হয়েছে রাখাইনের নৌ ঘাঁটিতে। একই সাথে ছোট ছোট গানবোট ও কমান্ডো অপারেশনের হাউটজার ক্যাননও আনা হয়েছে এ অঞ্চলে।
মিয়ানমারের রাখাইন ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল কমান্ডে তিনটি লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশন রয়েছে। এর মধ্যে বুচিডং সীমান্ত এলাকা পঞ্চদশ মিলিটারি অপারেশন কমান্ড (এমওসি), মুংডুতে রয়েছে ৩৩ লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশন। সীমান্ত এলাকায় ১১ ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৩ আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন, ৩৭১ আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন, ৩৮ স্পেশাল কমান্ডে ইউনিট মোতায়েন রয়েছে। এর বাইরে মারাকিউ ম্যানিবায়া টাউনশিপ এর ৯ মিলিটারি অপারেশন কমান্ড থেকে ৫৪০ লাইট ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৩৭৯ লাইট ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন ও ৩৭৬ আর্টিলারি ব্যাটালিয়নকে রাখাইনের সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত ৫ দিনে সিটওয়ে ওয়েস্টার্ন মিলিটারি কমান্ড, আন ও সিটওয়ের বিমান ঘাঁটি এবং সিটওয়ে নৌ ঘাঁটিতে সমর শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। হঠাৎ কেন এভাবে রাখাইনে সামরিক শক্তি বাড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে বেশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়টি জানার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাদের গতিবিধি গত কয়েক দিনে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, গত শুক্রবার থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি মিয়ানমারের সৈন্যদের টহল স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে বলে দেখা গেছে। সীমান্ত এলাকার অন্তত তিনটি পয়েন্টে সৈন্যদের ‘ব্যাপক সংখ্যক’ উপস্থিতি দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সীমান্তের লোকজন জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সীমান্তে চৌকি স্থাপনসহ তৎপর দেখা গেছে। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে সীমান্তের তমব্রু থেকে লেবুছড়ি পর্যন্ত এলাকায় এপার থেকে প্রতিদিন মিয়ানমার সেনা সদস্যদের নানা তৎপরতার দৃশ্য চোখে পড়ছে। আমাদের সন্দেহ, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) পোশাক পরে সেখানে অবস্থান করছে। তারা সেখানে ৭-৮টি তাঁবু টাঙ্গিয়ে নতুন অস্থায়ী চৌকি স্থাপন করছে, যা আগে ছিল না। এর আগেও বেশ কয়েকবার সীমান্তে সেনা টহল বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছিল।
শূন্যরেখায় বাস করা রোহিঙ্গা শিবিরের এক নেতা বলেন, ‘দুই দিন ধরে তমব্রু সীমান্তে গাড়ি চলাচল বেড়ে গেছে। যারা আসা-যাওয়া করছে তারা পুলিশ নাকি সেনাবাহিনী সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এই নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরের লোকজন ভয়ে আছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্তে নজরদারি করা সরকারি এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘মিয়ানমারে আগামী অক্টোবর মাসে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। হয়তো নির্বাচন ঘিরে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তাদের এই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। তবে আমরা সীমান্তে কঠোর নজরদারি রাখছি।
প্রসঙ্গত, চেকপোস্টে হামলার দাবি তুলে ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে গণহত্যা শুরু হয়। ওই সময়ও একইভাবে সীমান্ত এলাকায় সেনা সদস্যদের জড়ো করেছিল মিয়ানমার। ওই গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা সেখানে নিহত হন এবং প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ ছাড়াও আগে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে মোট সাড়ে ১০ লাখ উদ্বাস্তু এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তিনটি কারণে মিয়ানমারের এই সমরসজ্জা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, দেশটিতে যেসব রোহিঙ্গা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে তাদের ওপর দমন অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া। দ্বিতীয়টি হতে পারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো সার্জিক্যাল স্টাইক ধরনের কিছু করে চাপ তৈরি করা। আর তৃতীয় হতে পারে বিচ্ছিন্নতাকামী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করা।
এর মধ্যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনা নিয়ে মিয়ানমার সরকার তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে। দু’জন মিয়ানমার সেনা রোহিঙ্গা গণহত্যা চালানোর বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে গঠিত আদালত হেগ থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তরের দাবিও উঠেছে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের কাছে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছে।
এ দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। প্রভাব বিস্তার নিয়ে এই দু’টি বড় দেশে ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের শেষবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর বৃহৎ দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে এর প্রভাবও এই ইস্যুতে পড়তে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মিয়ানমার হলো চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার দেশ। দেশটির নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র সম্পর্ক উভয় ক্ষেত্রেই বেইজিংয়ের নানামুখী প্রভাব রয়েছে। ভারতের সাথেও মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের মতো হলেও সেনা সদস্য বিবেচনায় দেশটির প্রতিরক্ষা আকার দ্বিগুণ। চীন, রাশিয়া ও ইসরাইলের সাথে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে।