বিশেষ প্রতিনিধি।। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি মিরপুর-১০ নম্বরে সড়ক অবরোধ। ছবি- ফোকাস বাংলাগার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি মিরপুর-১০ নম্বরে সড়ক অবরোধ। ছবি- ফোকাস বাংলা
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। একইসঙ্গে আরও কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়ানোরও দাবি করেছেন তারা। আর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা ও রাজধানীর বাইরের প্রধান সড়ক শ্রমিকরা অবরোধ করেছে। এতে সাময়িকভাব বন্ধ করতে হয়েছে অনেক গার্মেন্টস।
তবে হঠাৎ করে এ ধরণের আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
তারা বলছেন, ৩ বছর আগে বেতন বাড়ানো হয়েছে। প্রতি বছর শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী ৫ বছর পর বেতন বাড়ানোর কথা। সেসময় যদি বেতন না বাড়ানো হয় তাহলে আন্দোলন হতে পারে। এখন হঠাৎ করে বেতন বাড়ানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
অবশ্য শ্রমিক নেতারা বলছেন, হঠাৎ করে নয় গত চার দিন ধরে মিরপুর এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। মঙ্গলবার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করেছে। আন্দোলন বন্ধ করতে বুধবার (২৪ নভেম্বর) সকালেও তারা শ্রমিকদের ওপর হামলা করে। উত্তেজিত শ্রমিকরা তাদের ধাওয়া করলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও মারামারি হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিজিএমইএ নেতাদের বৈঠকে শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বিকেলে বৈঠক করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা। বৈঠকে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, এমপি, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এমপি ও একে আজাদ, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বিজিএমইএর নেতারা বলেন, এখন যে আন্দোলন হচ্ছে তা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। আরও রপ্তানির জন্য নতুন করে আদেশ পাচ্ছে। তাই যেসব দেশ এ আদেশ বঞ্চিত হচ্ছে তারা ষড়যন্ত্র করছে। তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে শ্রমিকদের উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। তাই এর নেপথ্যে কারা আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে সাধারণ শ্রমিকদের যেন কোন ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান তারা।
বিজিএমইএর নেতাদের কথা সঙ্গে এক মত পোষণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তাদেরকে খুঁজতে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। দোষীদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও তিনি জানান।
পরে রাতে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে দেখা করেন বিজিএমইএর নেতারা।
মিরপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ
বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাজধানীর মিরপুরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। পুলিশ জানায়, গতকাল বুধবার সকাল ৯টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাস্তা আটকে শ্রমিকদের এ বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই এলাকার বিভিন্ন কারখানার শত শত শ্রমিক তাতে যোগ দেন। এ সময় রাস্তার ওপর প্লাস্টিক ‘রোড ডিভাডাইডারে’ আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় শ্রমিকদের। কারও কারও হাতে লাঠিও ছিল। দুপুর ২টার দিকে তারা সড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন পোশাক শ্রমিক বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দোম বেড়ে গেছে। বাড়িভাড়া ও বাস ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের বেতন বাড়েনি।
পোশাক শ্রমিক রাবেয়া আক্তার বলেন, আমরা বেতন ভাতার জন্য আন্দোলন করছি। মালিক পক্ষ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতো। কিন্তু তারা বাইরে থেকে লোকজন এনে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অনেকেই হামলায় আহত হয়েছে।
এই দাবিতে মঙ্গলবারও মিরপুর এলাকায় বিক্ষোভে নেমেছিলেন শ্রমিকরা। সে সময় ‘মালিকপক্ষের সন্ত্রাসীরা’ তাদের ওপর হামলা চালায় বলে শ্রমিকদের অভিযোগ।
মিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। মঙ্গলবার হামলায় শ্রমিক নিহত হয়েছেন বলে তারা দাবি করছে, তবে সেটা সত্য নয়। অবরোধের কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
ভাটারায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে করে। এজন্য ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে ভাটারা ও খিলক্ষেত পর্যন্ত প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। খরব পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভাটারা থানার পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ভাটারা থানার ডিউটি অফিসার ইভা আক্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ভাটারা এলাকায় অবস্থিত কোরিয়ান সোয়েন্টা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে।
চান্দিনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ
আমাদের চান্দিনা ও বুড়িচং (কুমিল্লা) সংবাদদাতা মামুনুর রশিদ সরকার জানিয়েছেন, বকেয়া বেতনের দাবীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে চান্দিনার “ডেনিম প্রসেসিং প্লান্ট” নামের একটি পোশাক কারাখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। গতকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে মহাসড়কের চান্দিনার বেলাশহর এলাকায় অবরোধ করে তারা। পরে আজ বৃহস্পতিবার বকেয়া বেতন পরিশোধ করার আশ্বাসে প্রায় পৌঁনে পাঁচ ঘণ্টা পর দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে অবরোধ প্রত্যাহার করে শ্রমিকরা।
দীর্ঘ পৌঁনে পাঁচ ঘণ্টার অবরোধে অচল হয়ে পড়েছে দেশের লাইফ লাইন খ্যাত ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের উভয় দিকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। যানজটে নাকাল হয়ে পড়েছে যাত্রী, গাড়ি চালক, বিদেশগামী, রোগী ও এসএসসি পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, চান্দিনার পশ্চিম বেলাশহরে অবস্থিত ‘ডেনিম প্রসেসিং প্লান্ট’ পোশাক শ্রমিক কারাখানায় প্রায় তিন মাস যাবৎ শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করছে না কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন বেতন ভাতা না পেয়ে অন্তত তিন হাজার ক্ষুব্ধ শ্রমিক ও কর্মচারীরা বুধবার সকাল ৯টা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনার বেলাশহর মিলগেইট এলাকায় অবরোধ করে। দীর্ঘ চার ঘণ্টা চেষ্টা করেও অবরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গিয়ে শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়েন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আশরাফুন নাহার। অবরোধ শুরুর পর থেকে মালিক পক্ষের লোকজন মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখায় বিপাকে পড়ে প্রশাসন।
পরে ‘ডেনিম প্রসেসিং প্লান্ট’ নামের ওই পোশাক কারখানা থেকে পুলিশ জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) হাবিবুর রহমানকে মহাসড়কে ডেকে অবরোধ স্থলে আনেন। পরে তিনি মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে (বৃহস্পতিবার) এর মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধ করার প্রতিশ্রতি দিলে দুপুরে ১টা ৪০ মিনিটে অবরোধ তুলে নেয় শ্রমিক- কর্মচারীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চান্দিনা থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান।
এদিকে, দীর্ঘ প্রায় পৌঁনে ৫ ঘণ্টার অবরোধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ থেকে বুড়িচং উপজেলার কাবিলা পর্যন্ত উভয় পাশে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধ প্রত্যাহারের পরও মহাসড়কে ধীর গতিতে চলছে যানবাহন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরেফিন ছিদ্দিকী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন, চান্দিনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তপন বক্সী, চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আশরাফুন নাহার, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জুয়েল রানা, পৌর মেয়র শওকত হোসেন ভুইয়া, চান্দিনা থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, দেবীদ্বার থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) আরিফুর রহমানসহ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চেষ্টা করছেন।
শ্রমিক নূরজাহান জানান, প্রতি মাসের ১০ তারিখে আমাদের বেতন ভাতা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত কাজ করে পোশাক তৈরি অব্যাহত রাখলেও গত এক বছর যাবৎ আমাদের বেতন অনিয়মিত। গত তিন মাস যাবৎ আমাদের বেতনের একটি টাকাও পরিশোধ করছে না। এমন অবস্থায় আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
অপর শ্রমিক মোহাম্মদ হোসেন জানান, বেতনের জন্য আমরা প্রতিবাদ করলেই মালিক পক্ষ আমাদের চিহ্নিত করে ছাঁটাই করে দেয়। তাদের (মালিক পক্ষে) সব কিছু ঠিক আছে, শুধু আমাদের বেতন দিতেই সমস্যা। আমাদের দিয়ে ওভারটাইম করায় কিন্তু সেই ওভারটাইমের টাকাও পাইনা। গার্মেন্টেসের প্রোডাক্টশন কোন মাসেই আমরা কম দেই না। কিন্তু মাস শেষে আমাদের বেতন নাই!
এদিকে, ওই গার্মেন্টেস এর একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, মূলত মালিকের কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট নাকি সরকার বন্ধ করে রাখছে। তাই মালিক পক্ষ শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।
এদিকে, দীর্ঘ যানজটে পড়ে আটকতে থাকা গাড়ি চালক মিজানুর রহমান জানান, কোন কিছু হলেই মহাসড়ক অবরোধ! এটা কেমন কথা। একটি কারখানার কারণে কত হাজার হাজার যানবাহন রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে। তা কি কেউ দেখে না? আমি সকাল সোয়া ৯টায় বেলাশহর এলাকায় আটকা পড়েছি, এখন প্রায় পৌঁনে ১টা বাজে এখনও এক চুল নড়তে পারছি না।
কুমিল্লার চান্দিনা ও দাউদকান্দি সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জুয়েল রানা জানান, বেতন ভাতার দাবীতে শ্রমিকদের সাড়ে চার ঘণ্টা ব্যাপী দীর্ঘ অবরোধে অচল হয়ে পড়েছে মহাসড়ক। তবে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোন নেতা না থাকায় এবং মালিক পক্ষের গাফিলতিতে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে ‘ডেনিম প্রসেসিং প্লান্ট’ গার্মেন্টসের পরিচালক আলমগীর হোসেন এর ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরেফিন ছিদ্দিকী জানান, আমরা অনেক চেষ্টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে মহাসড়ক অবরোধ মুক্ত করেছি। গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।