বিশেষ প্রতিনিধি।। অবিশ্বাস্য শুনালেও সত্য, মাত্র ৪০ টাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান বোর্ডিংয়ে রাতযাপন করা যায়। মেঝেতে ঢালা বিছানায় থাকলে ৪০ টাকা আর কেবিনে থাকলে ১০০ টাকা। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার ঘাটে রয়েছে এমনই ৪টি ভাসমান বোর্ডিং (হোটেল)।
এসব বোর্ডিংয়ে বিদ্যুৎ, নিরাপদ খাবার পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত আবাসিক হোটেলগুলোতে থাকার যে সুবিধা তার সবই আছে এই বোর্ডিংগুলোতে।
জানা যায়, পুরান ঢাকার বাবুবাজার, সদরঘাট, ওয়াইজঘাট ও আশপাশের এলাকাগুলোতে প্রচুর ভাসমান লোকজন কাজ করেন। যাদের থাকার জায়গা নেই। আবার বেশি টাকা খরচ করে আবাসিক হোটেলে থাকার সামর্থ্য নেই। মূলত এরাই বোর্ডিংগুলোর বাসিন্দা। অর্থাৎ হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা থাকেন ভাসমান বোর্ডিংয়ে। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। দিন শেষে এখানে নির্বিঘ্নে রাতযাপন করেন।
ভাসমান এই আবাসিক বোর্ডিংগুলো সম্পর্কে লোকমুখে জানা যায়, ১৯৬০ সালের দিকে বোর্ডিংগুলোর যাত্রা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা ব্যবসার কাজে ঢাকায় যাতায়াত করতেন। তারা ঢাকা শহরের মুসলিম হোটেলে উঠতে চাইতেন না। ওই সময় ঢাকায় আবাসিক হোটেলের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তখন হিন্দু ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে ঢাকার কিছু হিন্দু মহাজন বুড়িগঙ্গায় এ ভাসমান বোর্ডিংগুলো তৈরি করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু মহাজনরা এ ব্যবসা ছেড়ে ভারতে চলে যান। পরে এসব বোর্ডিং কিছু মুসলিম ব্যবসায়ীরা বুঝে নেন। শুরুর দিকে ভাসমান বোর্ডিংগুলো কাঠের তৈরি ছিল। ৯০ দশকের পরে এগুলো সংস্কার করে লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়। কয়েক বছর পরপর বোটগুলো ডকইয়ার্ডে এনে সংস্কার ও মেরামত করা হয়।
দীর্ঘসময় ভাসমান এই বোর্ডিংগুলো সদরঘাট এলাকায় ছিল। কয়েক বছর আগে মিটফোর্ড ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে বোর্ডিংগুলো রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। প্রতিটি বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন একজন ম্যানেজার।
সরেজমিন দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘাটের পাশে নদীতে ভেসে সারিবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে উজালা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বুড়িগঙ্গা নামের ৪টি বোর্ডিং। বোর্ডিংয়ে যাওয়ার জন্য নদীর তীর থেকে বাঁশ ও কাঠের সাঁকো রয়েছে। প্রতিটি বোর্ডিংয়ে ৩০-৩৫টি কক্ষ বা কেবিন রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের দৈনিক ভাড়া ১০০ টাকা। এছাড়াও মেঝেতে বিছানা পেতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যার জন্য জনপ্রতি গুনতে হবে ৪০ টাকা। সব মিলিয়ে একেকটি ভাসমান বোর্ডিংয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বোর্ডিংগুলোতে কেবল পুরুষ মানুষই থাকতে পারেন।
বোর্ডিংয়ে থাকেন মামুন নামে এক হকার। তিনি বলেন, পরিবার থাকে গ্রামে। ঢাকায় কোনো বাসাবাড়িও নেই। সারাদিন পরিশ্রম করার পর এখানে নির্বিঘ্নে ও কম টাকায় থাকতে পারি। মেসে থাকার চেয়ে এখানে থাকার সুবিধা বেশি।
বাবুবাজারে দিনমজুরের কাজ করা সবুজ বলেন, আমি দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এখানে (বোর্ডিং) থাকি। যখন প্রথম উঠেছিলাম, তখন কেবিন ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। প্রতিবছর অল্প অল্প করে বাড়তে বাড়তে এখন ১০০ টাকা হয়েছে। যখন বাড়িতে যাই তখন ভাড়া দেওয়া লাগে না। থাকলে ভাড়া না থাকলে ভাড়া নাই।
উজালা বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে থাকা ফরিদ নামে একজন স্টাফ বলেন, আমাদের রুমগুলো দৈনিক হিসাবে ভাড়া দেই। সিটি করপোরেশন থেকে বৈদ্যুতিক মিটার নেওয়া আছে। আর নদীতে বোটগুলো রাখার জন্য বিআইডব্লিউটিএর সব কাগজপত্র করা আছে।
তিনি আরও বলেন, এখানে অন্য কোনো ঝামেলা নেই। তবে কাস্টমার কমে গেছে। আগে বোটগুলো সদরঘাট ওয়াইজঘাট বরাবর ছিল। সেখানে অনেক কাস্টমার ছিল। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সুবিধার জন্য বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশে এখান থেকে আমাদের সরে যেতে হয়েছে। যার কারণে এখন মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘাটের পাশে বোটগুলো রাখা হয়েছে। এখানে বোটগুলো নিয়ে আসার কারণে পুরাতন কাস্টমার অনেকেই চিনে না। আবার সদরঘাট ওয়াইজঘাট থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় কাস্টমার অনেক কমে গেছে।
ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক মো. মোস্তফা মিয়া জানান, পাকিস্তান আমলে আমার মামা এ ব্যবসা করতেন। এখন আমি করছি। এক সময় এখানে শুধু রাতের খাবার খেলে ফ্রি থাকা যেত। এখন পানির সমস্যাসহ নানা কারণে খাবার বিক্রি করি না। তবে পুরাতন বোর্ডার যারা, তারা মিলেমিশে রান্না করে খান।