জিজ্ঞাসা
ছয় বছরের আজিম বাবার তর্জনী ধরে হেটে হেটে স্কুলে যাচ্ছে। আজ স্কুলে ভর্তি হবে । তাই সে মহাখুশি। বাবার গাড়ি আছে। কিন্তু ছেলের বায়না রক্ষা করতেই হেটে আসা। সমস্ত পথ জুড়ে তার সহস্র প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কখনো আব্বু আবার কখনো বাবা। বাবা এটা কী, ওটা কী, উনি কে, তোমাকে এত সালাম দেয় কেন ইত্যাদি প্রশ্ন। বাবা এখন ছেলের প্রশ্নবাণে মোটামুটি বিরক্ত। এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু ধমকাচ্ছেন।
- চুপ, আর একটা কথাও বলবে না! তোমার এত কিছু জানার দরকার কী!
- দেখলেই তো জানতে ইচ্ছে করে, আমি কি করব!
- তাহলে চোখ বুজে থাক। এত কিছু দেখার দরকার নেই।
বাবার ধমক আদেশ বলে মনে করে চোখ বন্ধ করে আজিম। চোখ বন্ধ করে হেটে চলেছে। রাজনীতিবিদ বাবা হাটছেন আর মানুষের সাথে কথা বলছেন। দশ মিনিটের পথ আধা ঘন্টায়ও শেষ হচ্ছে না। ছেলে তার কখন যে তর্জনী ছেড়ে দিয়েছে খেয়ালেই করেন নি। হঠাৎ দেখেন ছেলে সাথে নেই। দুশ্চিন্তা গাঢ় হবার আগেই একটা গাছের কাছে আবিষ্কার করেন তাকে।
- আজিম, তুমি এখানে কী করছো?
বাবার প্রশ্নের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সে গাছের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। বাবার কাছে তার অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক প্রশ্ন!
- আব্বু, গাছটাকে এরকম সাজিয়েছে কেন?
গাছটার দিকে তাকায় বাবা। একটা রেইনট্রি গাছ। কান্ড কিছু দূর উপরে উঠৈ চারদিকে ছাতার মতো শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে। ছেলের প্রশ্ন শুনে হাসি পায় তার।
- না না, সাজায় নি তো। বিভিন্ন লোক রাজনৈতিক ফেস্টুন লাগিয়েছে।
- ঐগুলোকে ফেস্টুন বলে?
- হ্যাঁ বাবা, ওগুলো ফেস্টুন।
হঠাৎ করে আজিমের উৎসুক মুখে খুশির রেখা জাগে।
- দেখ, আব্বু! ও খানে তোমার ছবিও আছে। কী সুন্দর তোমার ছবি!
ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসেন বাবা। ছেলের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে ভালই লাগছে তার। কোলে তুলে নিলেন ছেলেকে। ছেলের মনে তো আরও প্রশ্ন আছে।
- আচ্ছা, বাবা! ফেস্টুনগুলো গাছের সাথে কিভাবে লাগিয়েছে?
- কিভাবে আবার, পেরেক দিয়ে!
- পেরেক! গাছের তাতে কষ্ট হয় না,বাবা? কত গুলো পেরেক!
- ধুর বোকা! গাছের আবার কিসের কষ্ট! গাছের কী জীবন আছে?
- জীবন না থাকলে কষ্ট হয় না, বাবা?
এই বার ছেলের উপর বিরক্ত না হয়ে পারে না সে। কোল থেকে নামিয়ে দেয়। মুখের মধু উড়ে যায় নিমেষে।
- তুমি এত কিছু দিয়ে কী করবে? তারাতারি স্কুলে চলো।
স্কুলে পৌছাতে পৌছাতে ঘন্টা পড়ে গেল। তারাহুরো করে ভিতরে ঢুকলেন। কিন্তু হেডস্যার এখনো যে আসেন নি।
- আপনারা এখানে অপেক্ষা করেন। স্যার বারোটার আগে স্কুলে আসেন না।
এমনিতেই তো ছেলের প্রশ্নবাণে বিধ্বস্ত সে তার উপর হেডস্যারের বিলম্ব। বিরক্তির পারদ তর তর করে উপরে উঠছে। তার মতো একজন নেতা যার সবসময় লোক বসিয়ে রাখার অভ্যাস এখন সে-ই কিনা হেড স্যারের জন্য অপেক্ষা করছে। তার মতো মানুষের পক্ষে কারও জন্য অপেক্ষা করাটা মানায় না! ভিতরে ভিতরে রাগে জ্বলে যাচ্ছেন। এলোপাথারি মোবাইল চাপছেন।
সাড়ে এগারোটার দিকে স্যার আসলেন। পিওন এসে তাদের ডেকে নিয়ে গেল। বাবার হাত ধরে হেডস্যারের কক্ষে প্রবেশ করে আজিম।
- সালাম দাও, বাবা।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়া আলাইকুম সালাম। তোমার নাম কী, বাবা?
আজিমের মধ্যে কোনো ধরনের ভয় কাজ করছে না। সাবলীলভাবে হেড স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেয় সে।
- আমার নাম মুহাম্মদ আজিম।
- বাহ, সুন্দর নাম!
- আমার নাম তো শুনেছো, এখন তোমার নাম বল!
প্রথমে চমকে গেলেও পরক্ষনেই হেসে দিলেন হেড স্যার। আর বাবা আজিমকে সামলানোর চেষ্টা করছেন।
- আজিম, বেয়াদবি করে না!
হেড স্যার আজিমকে অভয় দেন। ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ করে আজিমের চোখ পড়ে হেডস্যারের পিছনে দেয়ালে ঝুলানো একটা ছবির দিকে। ছবিটা তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
- ওটা কার ছবি, স্যার?
স্যার পিছনে ফিরে বুঝতে পারলেন যে আজিম বঙ্গবন্ধুর ছবিটার কথাই জিজ্ঞেস করছে।
- উনি হচ্ছেন আমাদের জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
- ওহ। ওনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।
- কোথায় দেখেছো, বাবা?
বেশিক্ষণ চেষ্টা করার দরকার হয় নি। কোথায় ছবিটা দেখেছে তার মনে পড়ে গেছে। বাবার দিকে তাকায় সে।
- আব্বু! গাছের সাথে যে তোমার একটা ছবি দেখেছিলাম সেখানেই ওনার ছবি দেখেছি। তোমার ছবির উপরে এক কোনায়। ছোট্ট একটা ছবি। আর কত্ত বড় এই ছবিটা। আর কী সুন্দর!
- তুই এত কিছু দেখেছিস?
- হুম, দেখেছি তো! আব্বু তোমার ছবি এত্ত বড় আর তাঁর ছবি এত ছোট কেন? মনে হয় চোখেই পড়ে না! তুমি কী তাঁর চেয়েও বড়, আব্বু?
ছেলের কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যায় দেওয়ান সাহেবের। উত্তর খুঁজে পায় না। ছেলের উপর সে আজ মহা বিরক্ত। খুব চাপে আছেন তিনি। এখানে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলে ছেলে মান ইজ্জত যতটুকু আছে সেটাও শেষ করে দেবে। ছেলের কথায় কান না দিয়ে এখন যেভাবেই হোক বিদায় নিবেন। স্যারের সাথে আনুষ্ঠানিকতা সেরে চেয়ার ঠেলে উঠতেই চা নিয়ে আসে কর্মচারী ঝন্টু।
- চা এসে গেছে। চা খেয়ে যান।
হেড স্যারের অনুরোধে আবার বসতে বাধ্য হয় দেওয়ান সাহেব। হেড স্যার আর দেওয়ান সাহেব উভয়েই চা খাচ্ছেন আর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছেন। আজিম আছে অন্য রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত। টেবিলের উপরে রাখা নামফলকে তার চোখ।
- তোমার নাম তো আমি জেনে গেছি। তোমার নাম হলো- ‘জ’ এ ‘আ’ কার ‘জা’ ‘ক’ এ ‘ই’ কার ‘কি’ ‘র’ – জাকির। তুমি জাকির? তোমার নামটাও খুব সুন্দর!
বাবা ছেলেকে সামলাতে পারছেন না। এ কোন বিরম্বনায় পড়লেন তিনি। হেডস্যার চায়ের কাপ টেবিলে রেখে হাসছেন। আর আজিমের প্রশংসা করছেন।
- তুমি বাংলা পড়তে পারো, বাহ!
- হুম, পারি তো।
হেড স্যারের নামফলকের পাশেই রাখা একটা ক্যালেন্ডার। আজিমের নজর এখন ক্যালেন্ডারের ছবির দিকে।
- স্যার, এগুলো কী গাছের ছবি?
- এগুলোকে বলা হয় বনসাই।
- এত ছোট ক্যান এগুলো?
- এগুলো বড় হয় না কখনো। ছোটই থাকে।
- ওহ! কি সুন্দর গাছগুলো। আচ্ছা স্যার, গাছের কি জীবন আছে?
- হ্যাঁ আছে, বাবা।
- গাছ কি ব্যথা পায়, স্যার?
- হ্যাঁ। আমরা যেমন আঘাত পেলে ব্যথা পাই, গাছেরও তেমনি অনুভূতি আছে।
- কিন্তু স্যার, আব্বু যে বলে গাছের নাকি জীবন নেই। ওরা নাকি ব্যথা পায় না! ওদের নাকি কষ্ট হয় না!
দেওয়ান সাহেব লজ্জায় স্যারের চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। হেড স্যার আলোচনার মোর ঘুড়িয়ে দিলেন। ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ায় তিনিও ওনাদের বিদায় দিতে চাচ্ছেন।
- তাহলে, ঠিক আছে দেওয়ান সাহেব!
বাবাকে হ্যান্ডশেক করতে দেখে আজিমও হাত বাড়িয়ে দেয়। স্যার মুচকি হেসে আজিমের ডাকে সাড়া দেন। বাবার হাত ধরে দরজা পর্যন্তু গিয়ে আবার দৌড় দিয়ে ফিরে হেডস্যারের টেবিলের কাছে। হঠাৎ তার মনে আর একটা প্রশ্নের উদয় ঘটেছে।
- স্যার, জাতি কী স্যার? বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির জনক কেন?
- তুমি আরেকটু বড় হও তারপর বলব। এখন বাবার সাথে বাসায় যাও। কালকে স্কুলে এসো।
- ঠিক আসে, স্যার।
দেওয়ান সাহেবের বিদায়ের পর হেডস্যার কিছুক্ষণ দরজার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলেন। ছয় বছরের ছেলের কাছে দেওয়ান সাহেবের অসহায়ত্ব দেখে স্যার না হেসে পারলেন না। রাজনীতি তাহলে অজ্ঞদের দখলে! এই রাজনীতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে মন খারাপ হয় তার! তবে নিজে যে রকমই হোন, ছেলে একটা হয়েছে মাশাল্লাহ। বাপকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছে। ছেলেটা আসলেই ব্যতিক্রম। প্রতিভা আছে। অসম্ভব জানার আগ্রহ। এত অল্প বয়সেও ও যে বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করেছে তার তারিফ করতেই হয়। এই ছেলের হাত তিনি ছাড়বেন না। ওর এই জানার আগ্রহটা যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে।
আজিম নিয়মিত স্কুলে আসে। হেডস্যার আজিমকে নিয়ম করে নিয়মিত সময় দেন।খোঁজ খবর নেন। বাংলা ও ইংরেজি যেন দেখে পড়তে পারে তিনি এখন সেই চেষ্টা করছেন। চার মাসের মধ্যে তিনি সেই চেষ্টায় সফল হন। এখন আজিম যে কোন বাংলা এবং ইংরেজি লেখা দেখে পড়তে পারে। এমনকি সংবাদপত্রের লেখাও। আজিমের এই সাফল্যে হেড স্যার তো মহা খুশি।
- আজিম, তোমার উপর আমি খুব খুশি হয়েছি, বাবা। এটা তোমার জন্য।
- এটা কী স্যার?
- একটা বই। তোমার উপহার। আমার পক্ষ থেকে।
উপহার পেয়ে খুব খুশি হয় আজিম। নিজের অজান্তেই স্যার জড়িয়ে ধরলো সে। স্যারও নিষেধ করলেন না। বরং তার কাছে ভালই লাগে। আজিম পারলে বইটা এক্ষনি পড়ে ফেলে। কিন্তু স্যার বলেছেন বাসায় গিয়ে পড়তে। কিভাবে পড়তে হবে আর কখন পড়তে হবে সে কথাও বলে দিয়েছেন। বইটা শেষ করতে সময় দিয়েছেন বিশ দিন। স্যারকে ধন্যবাদ দেয় সে। দরজা পর্যন্ত যেতেই স্যার পিছন থেকে ডাক দেন তাকে।
- আজিম, তুমি কী করতে ভালবাসো, বাবা?
- স্যার, খেলা ধুলা করতে আর চকোলেট খেতে।
- আচ্ছা। তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?
- স্যার, আমি বড় হয়ে বাবার মতো হতে চাই। কেন, স্যার?
- কিছু না! কালকে স্কুলে এসো।
আজিম এখন বাংলা অনেক দ্রুত দেখে পড়তে পারে। বইটা বিশ দিনের মধ্যে সে দুইবার পড়ে ফেলে। তার পারফরম্যান্সে তো স্যার মহাখুশি। বিশ দিন পরে আজিম আরেকটা বই চায় স্যারের কাছে। স্যার আগের বইটা ভালভাবে পড়েছে কিনা সেটা একটু পরখ করতে দেখতে চান। টুকিটাকি কিছু প্রশ্ন করলেন বই থেকে। আজিম খুব ভালভাবেই সেসব প্রশ্নের উত্তর দেয়। স্যারও খুব খুশি হন। তিনি এবার তাকে আরেকটা বই দেন। এভাবেই দিন যায়, মাস শেষ হয়ে বছর হয়। আর আজিমের বই পড়ার নেশা বেড়ে যায়। স্যারের কাছ থেকে পাওয়ার পাশাপাশি সে মাঝেমধ্যে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বই কিনে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে নিয়মিত। পুরস্কার হিসেবে প্রচুর বই পেয়েছে। তার পড়ার ঘরটা একটা ছোট আকৃতির পাঠাগারে পরিণত হয়েছে। বই রাখার জন্য মা দুটি শেলফের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রতিনিয়ত আজিমের বইয়ের সংগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশির ভাগ বইই তার পড়া শেষ। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পূর্বেই তার পঠিত বইয়ের সংখ্যা দাড়ায় তিন শতাধিক।
পঞ্চম শ্রেণির প্রথম দিন। ক্লাস হচ্ছে না। সবাই হুরোহুরি আর খেলাধুলায় ব্যস্ত। কিন্তু আজিমের হঠাৎ মনে পড়ে হেডস্যারের কাছে তার কিছু প্রশ্ন আছে। হেড স্যার আজিমকে দেখেই বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই নতুন কোনো প্রশ্ন আছে তার।
- বাবা, আবার নতুন কোনো প্রশ্ন আছে নাকি?
- না, স্যার। প্রশ্ন পুরোনো।
- হ্যাঁ বলো।
- জাতি কী, স্যার?
- ওহ, বুঝতে পেরেছি। আসলেই তো পুরনো প্রশ্ন! তাহলে শোনো। জাতি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী যারা একই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আর বিশ্বাস ধারন করে এবং এই বিশ্বাসের কারনেই সেই জনগোষ্ঠী নিজেদের অন্য জনগোষ্ঠীদের থেকে আলাদা বলে মনে করে। অর্থাৎ, একটা জাতি একই বিশ্বাসে ও সংস্কৃতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তুমি ছোট মানুষ তোমার পক্ষে বোঝা একটু কঠিনই হবে। তবে আমি তোমাকে কিছু বই দিচ্ছি। এই বইগুলো পড়লে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে।
- মোটামুটি বুঝতে পেরেছি, স্যার। তবে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বাঙালী জাতির জনক কেন বলা হয় এ বিষয়টা বুঝলাম না।
- আচ্ছা, বলছি শোন।
- জনক শব্দের অর্থ হচ্ছে পিতা বা প্রতিষ্ঠাতা। যে কোনো জাতীর মুক্তি ও স্বাধীনতা যার নেতৃত্বে অর্জিত হয় জাতি তাকে ‘জাতির জনক বা পিতা’ উপাধিতে ভূষিত করে জাতীয় মুক্তিতে তার অবদানকে সম্মান ও স্বীকৃতি জানায়। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অর্জিত হয়। তার নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ কারণেই তাকে বাঙালি জাতির জনক বলা হয়।
- বুঝতে পেরেছি, স্যার!
- শোন, তিনি তার জীবনের পুরোটাই উৎসর্গ করেছেন এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির আন্দোলন আর সংগ্রামে। তার প্রায় পঞ্চান্ন বছর জীবদ্দশায় ৪৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন। বছরের হিসেবে তা প্রায় তের বছর। এই কারাজীবনের ৪৬৭৫ দিন জেল খেটেছেন পাকিস্তান আমলে আর ৭ দিন খেটেছেন ব্রিটিশ আমলে।
- কি বলেন, স্যার!
- হ্যাঁ। আর জেলে বসে তিনি কিছু বই লেখেন। একটু বসো, আমি আসছি।
কিছুক্ষণ পরে স্যার আজিমের হাতে চার পাঁচটা বই দিলেন। এগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই তিনটি রয়েছে। বইগুলো বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর লেখা বই তিনটি পেয়ে আজিম খুব খুশি।
অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর বইগুলো পড়া শেষ হয়ে যায়। বইগুলোতে প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্য খুব ভালভাবে করায়ত্ত্ব করে সে। পাশাপাশি এদেশের ইতিহাস ও মুক্তি সংগ্রাম সংক্রান্ত বইগুলোও পড়ে ফেলে। আর এতে করে বেঁধে যায় আরেক বিপত্তি। রাজনৈতিক মিটিং টিটিং হলে দেওয়ান সাহেব ছেলেকে নিয়ে যেতেন মাঝে মধ্যে। কিন্তু এখন আর তাকে নিতে চান না। এর যুক্তিযু্ক্ত কারণও অবশ্য আছে। মিটিং এ যারা বক্তৃতা করেন বেশিরভাগ লোকই ইতিহাস না জেনে কথা বলে শ্রোতাদের ভুল তথ্য দেয়। মাইক্রোফোন হাতে পেলে মুখে যা না হয় বলে ফেলে। এ তালিকায় তার বাবাও আছেন। রাজনীতি করেন অথচ সঠিক ইতিহাস জানেন না বিষয়টা তাকে অবাক করে। আর তাই সে বাবাকে সঠিক তথ্য দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করে। একদিন বক্তৃতার মাঝেই সে তার বাবার ভুল ধরে। মাথা হেট হয়ে যায় দেওয়ান সাহেবের। খুব লজ্জা পেয়েছিলেন সেদিন। ছেলেকে খুব ভালোবাসেন তাই সেদিন ওকে কিছু বলেন নি। তাছাড়া বাচ্চা ছেলে বুঝে শুনে তো কিছু করে নি! ছেলের এ ধরনে কাজ উপদ্রব বলে মনে হয় তার কাছে। এজন্য অবশ্য তিনি ছেলের হেডস্যারকেই বেশি দায়ী করেন।
আজিম বঙ্গন্ধুর লেখা বই তিনটা পড়তে দিয়েছিল বাবাকে। বাবা টেবিলে রেখে দিতে বললেন। পরে বইগুলো আর ধরেও দেখেন নি। একমাস পরে বইগুলো যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানেই পাওয়া যায়। বইএর উপরে ধুলা জমে ছিল এক ইঞ্চির মতো। খুব কষ্ট পেল আজিম। বইগুলো পরিষ্কার করে আবার সেখানেই রেখে দিল। হয়ত বাবার হাতে পড়ার সময় মেলে নি।
আজিমের মনে বড় কষ্ট আর বহু জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিবে কে? এমন কেন? বঙ্গবন্ধু তো জেলে বসে প্রচুর বই পড়তেন। তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা তাকে বই আর খাতা কলম দিয়ে যেতেন। তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। তিনি গাছ লাগানো ভালবাসতেন। এমনকি জেলে বসেও তিনি ফুলের বাগান করেছেন। বঙ্গবন্ধু তো গরীব দুঃখী মানুষকে ভালবাসতেন। অসহায়দের জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন, নিজের গায়ের চাদর খুলে অন্যকে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি তো মানবতার সেবা আর মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার বাবা দেওয়ান সাহেব! আজিম তার বাবার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছাপই লক্ষ্য করছে না।
চেয়ারম্যান হবার পরপরই তাদের শহরে পাঁচতলা নতুন বাড়ি ওঠে। বাবা সবসময় সাহায্য প্রার্থীদের তুই তোকারি করে কথা বলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন সাক্ষাত দেওয়ার জন্য। অনেককে আবার মারধরও করেন মাঝে মধ্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো এরকম ছিল না। তিনি তো মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সাথে মিশেছেন। তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন এবং সকলকে সে পরামর্শও দিয়েছেন। তাদের বুকে টেনে নিয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এমন কেন? বালকের মনের মধ্যে তার বাবার বিরুদ্ধে সহস্র প্রশ্ন আর অভিযোগের পাহার জমে আছে। যে কোনো সময় মহা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছেন দেওয়ান সাহেব। দেখলেন যে আদরের ছেলে আজিম তার গলায় ছুরি চালাচ্ছে। হেড স্যার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে হাসছেন আর আজিমকে উসকে দিচ্ছেন! ঘুম থেকে একরকম লাফিয়ে ওঠেন তিনি। ঘেমে একেবারে গোসল করে ওঠার মতো অবস্থা। বুকের ধরফর থামছে না। মাঝ রাতের পর আর ঘুম হয় নি তার। এখনো তিনি সেই স্বপ্নের কথাই ভাবছেন। এ কী দেখলেন তিনি! এ যেন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তিনি খেয়াল করেছেন যে ছেলে তার দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রশ্ন সেই প্রশ্ন করে করে মাথা খেয়ে ফেলে। দেওয়ান সাহেবের দৃষ্টিতে হেডমাস্টারটাই খারাপ। তিনিই আজিমকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন। তার আস্কারা পেয়েই আজিম বাবাকে অপদস্ত করছে। হয়ত ভবিষ্যতে এই ছেলে আরও বড়ও বিপদের কারন হয়ে দাড়াবে। তাই অনাগত ভবিষ্যতের অশুভ পরিণতি থেকে মুক্তি পেতে হলে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ঐ দিকে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া আজিমও বাবার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আর প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে প্রস্তুত। সেদিন সকালবেলাই আজিম প্রশ্নের ডালা নিয়ে বাবার সামনে হাজির।
- বাবা, তুমি বইগুলো ধরেও দেখলে না!
খুব আক্ষেপ আর কষ্ট তার মনে। কিন্তু এই প্রশ্ন হজম করতে পারেন না দেওয়ান সাহেব। ক্ষেপে যান তিনি।
- কিসের বই? বেশি পড়ুয়া হয়ে গেছ তুমি? তোমার আর পড়ার দরকার নেই। ছোট বেলা থেকে তুমি আমাকে বিরক্ত করছো। বেশি ইতিহাস জেনে ফেলেছো?
টেবিলের উপর রাখা বই তিনটা ফ্লোরে ছুড়ে মারে সে। প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন তিনি।
- বাবা, এ কী করছো তুমি? এমন করছো কেন?
- চুপ, বেয়াদব! একদম কথা বলবি না! মাস্টারের আস্কারা পেয়ে তুই বড় বেশি বেযাদব হয়ে গেছিস! আজকে আমার একদিন আর মাস্টারের একদিন।
খুব ভয় পেয়ে যায় আজিম। বাবাকে এমন অগ্নিশর্মা হতে কখনোই দেখে নি সে। বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। কখনো বাবা তার সাথে এমন আচরণ করে নি। নিতে পারছে না আজিম। কেঁদে ফেলে সে। তাতেও রাগ টলে না দেওয়ান সাহেবের।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘরের রুমের বাইরে বের করে দেন ছেলেকে। হেডস্যারের সাথে বড় ধরনের বোঝাপারা আছে তার।
আজিমকে স্কুলে না দেখে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যান স্যার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে বাবার সাথে স্যারের রুমে প্রবেশ করে। আজ সে বাবার তর্জনী ধরে নেই বরং বাবাই তার হাত ধরে রেখেছে। চোখে মুখে তার রাজ্যের ক্রোধ! আর আজিমের চোখে পানি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে তার।
- আপনি আমার ছেলেকে আস্কারা দিয়ে বেয়াদব বানিয়েছেন?
- কী বলছেন, দেওয়ান সাহেব? কী হয়েছে?
- কিছু হয় নি। আপনি আমার ছেলের ব্যাপারে আর নাক গলাবেন না। আপনার স্কুলে ওকে আর রাখবো না।
- মানে?
- টি. সি. দেন। ওকে অন্য স্কুলে ভর্তি করব।
স্যার ধীরে ধীরে সবই বুঝতে পারলেন। আজিমের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। খুব কাঁদছে ছেলেটা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে টি. সি. দিয়ে দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলেন, স্যার। দেওয়ান সাহেবের মুখের উপর তিনি আর কোনো কথাও বললেন না। টি. সি. দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করলেন তিনি।
দেওয়ান সাহেব আজিমের হাতটা এখনো ছাড়েন নি। বাবার সাথে রুম থেকে বের হতে হতে কয়েকবার পিছনে ফিরে স্যারকে দেখে সে। স্যারের চোখও ছলছল করছে। দরজা পর্যন্ত যেতে না যেতেই শেষবারের মত স্যার আবার ডাক দিলেন।
- আজিম, তুমি কী করতে ভালবাসো, বাবা?
আজিম অঝোরে কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উত্তর দেয় সে।
- স্যার, জিজ্ঞাসা।
- তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?
- স্যার, আমি আপনার মতো হতে চাই।
স্যারের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ আর আশির্বাদ মিশ্রিত লোনাজল।
- ভালো থাকিস, বাবা!
কামরুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)
পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,
পিরোজপুর।