খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে:- চিকিৎসক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির তীব্র জনবল সংকটের মধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র বিভাগীয় শহর বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) নতুন বর্ধিত ভবনে চালু করা হয়েছে ১২৫ শয্যার করোনা ইউনিট।
অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করোনা ভাইরাস ঢুকে পরায় তা প্রতিরোধের জন্য বরিশালে জেলা পর্যায়ের কমিটির সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া করোনা থেকে রক্ষা পেতে বরিশালে ব্যাপকহারে মাস্কের ব্যবহার বেড়েছে। এ কারণে সার্জিক্যাল দোকানগুলো মাস্ক শুন্য হয়ে পরেছে।
সূত্রমতে, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্প্রতি সময়ে শেবাচিমের মূলভবনে পাঁচ শয্যার করোনা ইউনিট স্থাপন করে কর্তৃপক্ষ। অতিসম্প্রতি নতুন করে করোনা ইউনিট আইসোলেশন করার নির্দেশনা আসায় পুরনো ভবন থেকে করোনা ইউনিট ৯ মার্চ দুপুরে নতুন বর্ধিত ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন ওই ইউনিটে স্থাপন করা হয়েছে ভেল্টিলেশন মেশিনসহ যাবতীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চিকিৎসক। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩০ জনের একটি নার্স টিম।
হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ বাকির হোসেন জানান, নতুন ভবনে আড়াইশ’ শয্যা করার মতো স্থান রয়েছে। তবে আপাতত ১২৫টি শয্যা স্থাপন করা হয়েছে। করোনা ইউনিটের জন্য স্থান এবং চিকিৎসা সামগ্রী থাকলেও চিকিৎসক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির তীব্র জনবলের পাশাপাশি দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালে কিট সংকট রয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অবহিত করা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, করোনা আক্রান্ত কোন রোগী সনাক্ত হলে তাকে করোনা ইউনিট আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেখে হটলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হবে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, পুরনো পাঁচশ’ শয্যার জনবল কাঠামো অনুযায়ী শেবাচিম হাসপাতালে ২২৪টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৯৭ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৪২৬ জন কর্মচারীর বিপরীতে রয়েছেন ৩০২জন।
পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেন আরও বলেন, দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও এনিয়ে আতঙ্কের কোন কারণ নেই। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত। কাউকে ভাইরাস আক্রান্ত মনে হলে তাকে নতুন ভবনের নিচতলায় স্থাপিত আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হবে। এছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলায় ভাইরাস মোকাবেলায় শেবাচিমের অধ্যক্ষ ডাঃ অসিত ভূষণ দাসকে প্রধান করে চার সদস্যর একটি কমিটি গঠণ করা হয়েছে।
জেলা পর্যায়ের কমিটির সভা \ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রবেশ করায় বরিশালে করোনা প্রতিরোধে ৯ মার্চ সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সম্মেলন কক্ষে জেলা পর্যায়ের কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমানের সভাপতিত্বে সভায় শেবাচিম হাসপাতালে আলাদা করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের আলাদা কেন্দ্র স্থাপন, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে করোনা ভাইরাস সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বেশি করে হাত ধোয়ার পরামর্শ, বিদেশ ভ্রমণ অথবা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা সীমিত করতে বলা, বিদেশ থেকে কেউ আসলে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ পূর্বক জেলা সিভিল সার্জন অফিস অথবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাকে অবহিত করার জন্য বলা হয়। গণপরিবহনে মাক্স ব্যবহার করা, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করনীয় বিষয়সমূহ সচেতনতার জন্য প্রচার-প্রচারণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় সভাপতি জেলা প্রশাসক করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সকলকে সচেতন হবার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্য বলেছেন।
কোরিয়া ফেরত দুই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত নন \ কর্মস্থল দক্ষিণ কোরিয়া থেকে নিজগ্রাম আগৈলঝাড়ায় ছুটিতে আসা দুইজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের কোন উপস্থিতি পায়নি চিকিৎসক দল। মঙ্গলবার সকালে উপজেলা হাসপাতালের মেডিকেল টিমের প্রধান ডাঃ জাহিদ হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের একটি মেডিকেল টিম দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশে ফেরা সোহাগ খলিফা ও মনির মুন্সির বাড়িতে গিয়ে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তারা দুইজনেই দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত ছিলেন। তিনি আরও বলেন, উপজেলার গৈলার কালুপাড়া গ্রামের আব্দুর রহিম খলিফার পুত্র সোহাগ খলিফা ও দক্ষিণ শিহিপাশা গ্রামের নুরুল হক মুন্সির পুত্র ইসলাম এমডি জাহিদুল ওরফে মনির মুন্সি গত রবিবার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাড়িতে আসেন। খবর পেয়ে সোমবার বিকেলে তাদের বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ওই দুইজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের কোন প্রাথমিক আলামত পাওয়া যায়নি। ডাঃ জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় হযরত শাহ জালাল (রঃ) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরেও ওই দুইজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায়ও তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। উভয় জায়গার স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাগজপত্রে তাদের করোনা ভাইরাসের কোন উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিভাগে প্রস্তুত পাঁচশ’ শয্যা \ দেশে তিনজন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর বরিশালেও কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস প্রতিরোধে বিভাগের হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুত করা হয়েছে পাঁচশ’ শয্যা। করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে, সতর্কতা ও স্বাস্থ্য বিভাগের ঘোষিত নিয়মাবলী মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে জনসচেতনতায় মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাস জানান, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক সংক্রমণ প্রতিরোধে বরিশাল বিভাগজুড়ে একটি বেসরকারিসহ ৪২টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আইসোলেশন ওয়ার্ডের মাধ্যমে প্রায় পাঁচশ’ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সব স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভাগের সব বেসরকারি হাসপাতালকে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এরমধ্যে প্রস্তুত রাখা শয্যার মধ্যে বরিশাল নগরীর বেসরকারি সাউথ অ্যাপোলো মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ২৫০ শয্যা ও শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫০ শয্যার মধ্যে ১২৫টি ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া জেলা পর্যায়ে সদর হাসপাতালগুলোতে পাঁচটি ও বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে গড় হিসেবে দুই থেকে তিনটি করে মোট প্রায় একশ’ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মাস্ক এবং হ্যান্ডওয়াশ সংকট \ এদিকে সম্ভাব্য করোনা থেকে রক্ষা পেতে বরিশালে মাস্ক এবং হ্যান্ডওয়াশের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে সার্জিক্যাল দোকানগুলোতে মাস্কের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক দোকানে মাস্ক নেই বললেই চলে। ২/১টি দোকানে অল্পকিছু পাওয়া গেলেও তার দাম পূর্বের চেয়ে বহুগুন বৃদ্ধি করে বিক্রি করা হচ্ছে। নগরীর বগুড়া রোডের বরিশাল সার্জিক্যালের রতন চক্রবর্তী জানান, করোনা ভাইরাসের শুরু থেকেই মাস্কের ব্যবহার বেড়ে গেছে। অতিসম্প্রতি মাস্কের ব্যাপক চাহিদা রেড়ে যাওয়ায় ঢাকার মোকামে চাহিদাপত্র দিয়েও তারা মাস্ক পাচ্ছেন না। এ কারণে গত কয়েকদিন থেকে তাদের কাছে মাস্ক নেই। বরিশালের আটটি সার্জিক্যাল দোকানের কোনটিতেই মাস্ক নেই বলেও তিনি (রতন চক্রবর্তী) উল্লেখ করেন। একইভাবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নগরীতে হ্যান্ডওয়াশের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।