অসুখবিসুখ একটু-আধটু হয়েই থাকে। কিন্তু কিছু অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তা না হলে খুব বিপদ আসতে পারে। অথচ সামান্য নজর দিলে বেশ ভালোভাবেই জীবন চলে। উচ্চ রক্তচাপ এ রকম একটি অসুখ। মুশকিল হলো আমাদের অনেকেই জানি না নিজের রক্তচাপের অবস্থা কী। নিয়ন্ত্রণে আছে, নাকি বেড়ে চলেছে। যখন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক বা কিডনি বিকল হয়, তখন আফসোস করি। এমনকি জীবনের ওপর ঝুঁকি আসে।
গত মাসে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস উপলক্ষে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস ও প্রথম আলোর উদ্যোগে একটি ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, সময়মতো ব্যবস্থা নিলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
দরকার সচেতনতা। এ জন্যই অন্তত একটি দিন আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, যাতে রক্তচাপ বিষয়ে কিছু জরুরি তথ্য সম্পর্কে সবাই সতর্ক হতে পারেন। শুধু জানার অভাবে যেন কারও জীবন বিপন্ন না হয়।
সাধারণভাবে আমরা মনে করি, ৬০-৭০ বছর না হলে অন্তত রক্তচাপ নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। সে জন্যই আমাদের অনেকেই নিশ্চিন্ত থাকি। তারপর হঠাৎ একদিন হয়তো উচ্চ রক্তচাপের কারণে ফিট হয়ে পড়ি বা বুকে ব্যথা শুরু হয়। অথচ বয়স মাত্র ৩০। বলতে গেলে জীবনের শুরু। জটিল কোনো অসুখ না থাকলে এই বয়সে তো সে রকম কিছু হওয়ার কথা নয়। এখানেই সমস্যা।
এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ২০ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তাঁদের অনেকে জানেনই না এর পরিণাম কী হতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ বাড়ছে। অনিশ্চয়তার কারণে সহজেই অস্থির হয়ে পড়ি। আবার অনেকে বিড়ি-সিগারেট টানেন বা মাদক সেবন করেন। রাত জেগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। আধুনিক জীবনের নানা জটিলতা আমাদের রক্তচাপ বাড়ায়।
এ জন্যই ৩০-৩৫ বছর পার হলে বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরীক্ষার কথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন। অন্য কোনো অসুখবিসুখ না থাকলেও নিয়মিত এই চেকআপ দরকার। যদি চিকিৎসক মনে করেন রক্তচাপ কোনো কারণে সীমার বাইরে চলে গেছে, তাহলে ওষুধ দেবেন। নিয়মিত ওষুধ সেবনে ভালো থাকা যায়।
কারও কারও একটা ভুল ধারণা আছে যে একবার ওষুধ খাওয়া শুরু করলে সারা জীবনই ওষুধ খেতে হবে। তাই হয়তো তাঁরা মনে করেন, ওষুধের দরকার নেই, সাময়িক সমস্যা, সময়ে সেরে যাবে। এটা শুধু ভুল ধারণাই নয়, জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এসব বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। অনেক সময় সাময়িক কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে। সে জন্য হয়তো ওষুধ খাওয়া দরকার। সারা জীবন খেতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক মাত্রায় চলে আসতে পারে। কিন্তু এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করলে আরও ক্ষতি হতে পারে।
এর একটি কারণ আছে। যখন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ খাওয়া শুরু করি, তখন শরীর নিজস্ব স্বাভাবিক উদ্যোগে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে। এরপর যদি হঠাৎ ওষুধ খাওয়া বন্ধ করি, তাহলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যায় এবং বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ জন্য ওষুধের ডোজ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হয়। হঠাৎ করে বন্ধ করা উচিত নয়। এসব বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। একবার ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন চালাতে হবে, তা নয়। নিয়ন্ত্রণে আনার পর কখন কীভাবে ওষুধ কমিয়ে আনতে হবে, সেটা চিকিৎসকই ভালো বুঝবেন। নিজে নিজের চিকিৎসা করা ঠিক নয়।
তবে আর একটা ভালো ওষুধ আছে। সেটা হলো নিয়মিত ব্যায়াম। যাঁরা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেন, তাঁদের হয়তো আর ব্যায়ামের দরকার নেই। কিন্তু অন্যদের জন্য দরকার। আজকাল শহরের ব্যস্ত জীবনে প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে অন্তত এক ঘণ্টা হাঁটা দরকার। সময়ের টানাটানি থাকলে নাহয় ১৫ মিনিট হাঁটুন। অফিসে তিন থেকে চারতলা পর্যন্ত হেঁটে উঠুন। লিফট নাহয় কম ব্যবহার করুন। সারা দিন কম্পিউটারে কাজ করলে এক-দু ঘণ্টা পরপর টেবিল ছেড়ে উঠে দু-চার মিনিট এক রাউন্ড অফিসের ভেতরেই হাঁটুন। দিনে অন্তত ২০-৩০ বার খোলা বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিয়ে একেবারে বুক খালি করে শ্বাস ছাড়ুন। একেই বলে ‘ব্রিদিং এক্সারসাইজ’।
ব্যায়াম প্রতিদিনের সঙ্গী হলে রক্তচাপ সহজে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না। এ কথা সাধারণত আমরা মনে রাখি না। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতা না থাকলে, অন্তত ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এর চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই।
তথ্য সংগ্রহঃশাহজাহান সরকার