কলকাতার জোড়াসাঁকো বিশ্ব কবি “রবীন্দ্রনাথের” বাড়িটি ছাদ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ঠিক আমার বড় জা’য়ের বাবার বাড়ির ছাদ থেকে। কলকাতার বড় বাজার গিয়েছিলাম ২০০২ সালে।
ছাদ থেকে প্রিয় কবির বাড়ির নাগাল পেয়ে আমার দুটো চোখ যেন খুশিতে, চোখের জলে ছল-ছল করেছিল! আমার বড় জা বুঝতে পেরে আমাকে বলছে, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় আছো বুঝি তুমি? আরও বললেন, আমিতো ছোট বেলা থেকে রোজ একবার করে প্রতিদিন এই বাড়িটি দেখি, তাই এখন আর তোমার মতো সুন্দর অনুভূতিগুলো সেইভাবে আমার মধ্যে নেই!
আমি বললাম দিদিভাই কত ভাগ্য তোমার! তুমি ঠাকুর বাড়ির কয়েকটি বাড়ির আগেই থাক আহা! কী শান্তি! প্রিয় কবির দুষ্টুমিগুলো মন- প্রাণ ভরে দেখ তুমি কল্পনায় বা স্মৃতিতে। কত কিছু জানো তুমি কবির বাড়ি নিয়ে। কত কথা, কত-শত স্মৃতি তোমার।
কী উত্তর দিয়েছিল দিদিভাই ঠিক আমার মনে নেই। অনেক দিন আগের সেই স্মৃতিকথা আমার। কিন্তু রবীন্দ্র যেন আমার স্মৃতির মানস পটে আঁকা জীবন্ত ছবি হয়ে আছে আমার মনের ক্যানভাসে।
আমার আর অপেক্ষার তর সইছিলনা! কখন যাব চৌকাঠ পেরিয়ে বৈঠকখানা তার পর পুরোপুরি অন্দরমহলে!
ভাবছিলাম আমি, কবি কী ছোট বেলাতে তাঁর এই বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে, কারো সাথে বর, বউ সেজে পুতুল খেলেছিলেন কীনা? কখন সব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করব ভাললাগার রস আস্বাদন করতে মরিয়া হয়ে উঠলাম মনে মনে এই আমি! তাই গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলাম……
“তুই ফেলে এসেছিস কারে মন
মনরে আমার! তাই জনম গেল
শান্তি পেলি নারে মন মনরে আমার “
দুপুরের খাবার খেয়েই ছুটে গেলাম, একেবারে পাশের কয়েকটি বাড়ির পরেই এই বিশাল বড় জমিদার বাড়িটি।
ওখানে পা রেখেই আমি মনে হয় এতদিনে স্বর্গ পেয়েছি।আমার প্রিয় কবির বাড়ি বলে কথা!
সামনে ঢুকে দেখি কবির দাদু আর কবির বিশাল পাথরের মুর্তি বানানো রয়েছে! স্মৃতি ফলক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক বাড়ির সামনে।
ক্যামরা নিয়ে ঢোকার উপায় নেই তাই জমা দিয়েই ঢুকতে হল। যথারীতি জুতো জমা রেখে খালি পায়ে যেন বাড়িটির সাথে শারীরিক মানসিক সম্পর্ক টের পাচ্ছিলাম আমি খুব নিবিড় ভাবে স্পর্শের একান্ত অনুভূতিতে।
বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢুকতেই প্রথমে দেখতে পেলাম বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশালাকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। লাল রঙের বাড়ি। ঐ এলাকাটা খুব শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজ করছে সারা বাড়ি জুড়ে নির্জনতার চাদরে যেন মোড়া! পরম শান্তি বিরাজমান!
তাই বুঝি কবি লিখেছেন এ খানে বসে বসে ……..
” আনন্দলোকে ,মঙ্গলালোকে
বিরাজ সত্য সুন্দর
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগন মাঝে”
ঢুকতেই হাতের বায়ে কবি কে নিয়ে মিউজিয়াম। আছে কতশত অর্জনের নজির বিহীন ইতিহাস। প্রচুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। ঘুরে ঘুরে সব কিছু অবলোকন করছিলাম। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে দেখছিলাম।
এই মহল থেকে নীচে নেমে উঠোন পেড়িয়ে ঠিক হাতের ডানে,
দোতলায় উঠেই দেখি বাড়ির ভেতর প্যাচানো লোহার সিঁড়িটা। হঠাৎ চোখে পড়ল কবির আত্মজীবনী মূলক লেখা। “আমার ছেলে বেলা” অন্য এক জায়গায় পেলাম ফ্যামিলি ট্রি পরিবারের সদস্যদের পরিচয় বিশদ ভাবে লেখা।ভীষণ ভালো লাগলো ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও আধুনিক সাজ ও পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মুগ্ধ হলাম পড়ে ও যেনে!
দোতলায় ঘরে উঠে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি কবির আঁতুড় ঘর, যেখানে কবির মহেন্দ্রক্ষণে জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা হয়ে। কবির পড়ার টেবিল, কবির শোবার ঘর। তাঁর শয়ন কক্ষে বড় একটি পালংক পড়ে আছে! যেখানে কবি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন!
“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম!
নিবিড় নিবৃত পূর্ণীমায়
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে
নিশীথিনী-সম”
আরও দেখলাম ব্যবহার করা কত ফার্নিচার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তবে হ্যাঁ বেশ পরিস্কার আর বেশ পরিপাটি ভাবে। কবির পড়ার টেবিলে একটু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। আহ্! কী ছিল এখানে যে অবলীলায় কবি সব লিখেছেন কত-শত শব্দের জালবুনি! কী নেই লেখা কবির মহাসাগরীয় ভুবন জুড়ে। কী যাদু ছিল, যাদুর টেবিলে?
বড্ড ইচ্ছে করছে লিখতে আজ কবির বাড়ির শ্বেত পাথরের যে টেবিলটি কবির কক্ষে ছিল। ঠিক একই ডিজাইন এবং একই শ্বেত পাথরের দুটো টেবিল ছিল আমার বাবার বড়িতে। এবং এটাই একসময় পরিবারের সকলের হাত বদল হয়ে আমার পড়ার টেবিল হিসেবে ছিল। এটা দেখার পরে আরও বেশি ইমোশনাল লাগলো আমার কাছে। হ্যাঁ মেলাতে চাইনি কিন্তু অনেক কিছুর মিল পেলাম এমন কী পালংকের ডিজাইনও। আর ঠাকুর বাড়িতেও নিয়ম ছিল নিজস্ব পাল্কী চড়ে বিয়ের প্রচলন। এটাও আমাদের বাড়ির বিয়েতে নিয়ম ছিল একসময়। যেহেতু আমাদের বাড়িটিও দু’শবছরের পুরোনো একটি জমিদার বাড়ি!
যাহোক, পাশের ভিন্ন একটি কক্ষে দুষ্টু রবীন্দ্রনাথের দুষ্টু মিষ্টি দুষ্টুমিগুলোর সাক্ষর বহন করছে। কত রোমান্টিক টাইপের দুষ্টু ছিলেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ! বেশ মজা করে ঢং করে পুতুল বানিয়েছেন ! মাটি, বাঁশ বেত,কাঠ,পাট,কাপড়, নারিকেল দিয়ে কার্টুন! যখন যেটা মনে ধরেছে তাই করেছেন! দুষ্টুমি গুলো কে আলাদা করে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে সেখানের একটি নিদিষ্ট জায়গায় বা কক্ষে।
চোখে না দেখলে সত্যিই বিশ্বাস করা মুস্কিল কত মজার এবং রোমান্টিক একজন মানুষ ছিলেন তিনি! দুষ্টুমির সৃষ্টিগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করছে তাঁর মজার ছেলেবেলার।
আমিতো এসব দেখে রোমান্টিক কবির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি রবীন্দ্রনাথের প্রেমে বহুবার পড়েছি বিভিন্ন ভাবে। তাতে কার কী এসে গেল তা নিয়ে আমার কোন ভাবনা ছিল না কোনোকালে।
বিশাল বাড়ির করিডোর, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম বাহারী রঙের পাঞ্জাবি পরে, কবি যেন সারা উঠোন জুড়ে ছুটোছুটি করছেন।
আমি মুগ্ধ হলাম! কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছে ছোট্ট রবীন্দ্র যেন চারিদিকে হাঁটছেন এবং তাঁর চিরচেনা অভ্যাস পেছনে দুটো হাত পিঠে দিয়ে ধব-ধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে। কখনো পুলকিত হচ্ছেন তিনি কখনো বা চঞ্চলতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন! কখনো বা আনমনা মন নিয়ে দেখছেন আমায়! আর যেন বলে উঠলেন….
” কে এই তুমি গো নন্দিনী ? আগেতো কখনো তোমায় আমি এখানে দেখিনি!
আমার কল্পনার অনুভবে ভীষণ রোমাঞ্চকর অনুভূতির অনুরণন হয়ে বেজে গেল যেন আমার হৃদয়ের মাঝে!
কবি তাই বুঝি গেয়ে উঠেছিলেন…….
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায়
বাহির পানে চোখ মেলেছি
আমার হৃদয় পানে চাইনি”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১ তম জন্মদিনে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রইল??