বিশেষ প্রতিনিধি।। পদ্মা সেতুতে যানবাহন পারাপার ও টোল আদায়ের পরিমাণ বাড়ছেই। গত ২৫ জুন উদ্বোধনের দিনসহ ধরলে গতকাল পর্যন্ত প্রথম সাত দিনে পদ্মা সেতুতে
টোল আদায় হয়েছে ৩ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে পদ্মা সেতুতে শুরু থেকে অন্যান্য সেতুর মতো সাধারণ পন্থায় টোল আদায় হচ্ছে। তবে এ পদ্ধতিতে বেশিদিন টোল আদায় হবে না। সেতুর দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় বসানো হবে আধুনিক ইলেকট্রনিকস টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ। এ ছাড়া যানবাহনের উইন্ডশিল্ডে লাগাতে হবে বিশেষ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) কার্ড। ফাস্ট ট্র্যাকের মাধ্যমে এই প্রি-পেইড কার্ড থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল কেটে নেবে ইটিসি বুথ। এতে চলমান গাড়ি থেকে মাত্র ৩ সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদায় হবে টোল। সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, এ পদ্ধতি চালু হতে ৬ মাসের মতো সময় লাগবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় শুরু হলে আদায়ের হার দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা। এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষ মনে করছে সামনে কোরবানির ঈদ থাকায় এখন থেকে প্রতিদিনই পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারের হার বাড়তেই থাকবে, সেই সঙ্গে বাড়বে টোল আদায়ের হারও। শুক্রবার যেমন রেকর্ড ৩ কোটি টাকারও বেশি টোল আদায় হয়েছে, তেমনি এখন প্রায় প্রতিদিনই এই হারে টোল আদায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসাবে যদি প্রতিদিন গড়ে ৩ কোটি টাকার মতো টোল আদায় হয় তাহলে ৩০ বছরে পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায় হবে ৩২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে পদ্মা সেতু তৈরিতে যে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, তা ৩০ বছরের আগেই উঠে যাবে। আর ৩৫ বছরে পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায় হবে ৩৮ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. মাহমুদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে পদ্মা সেতুতে গাড়ি পারাপার ও টোল আদায়ের হার তত বাড়ছে। আমরা খুবই আশাবাদী, ঈদের কারণে আগামী দিনগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ টোল আদায় হবে পদ্মা সেতু থেকে। সে ক্ষেত্রে গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার মতো টোল আদায়ের প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের। আমরা এখন চেষ্টা করছি গাড়ির চাপ বাড়লে কীভাবে আরও দ্রুত টোল আদায় সম্পন্ন করা যায়। সেজন্য টোল আদায়ের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন তাদের দক্ষতা আরও বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, ‘যে হারে টোল আদায় হচ্ছে তাতে ৩০ বছরের আগেই পদ্মা সেতুর খরচ উঠে যাওয়ার কথা। তবে সেটি এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। এক বছর সময় পার হওয়ার পর একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে কত বছরে টাকা উঠবে। সেজন্য আমরা এখনও এ ধরনের কোনো ফিগার বলতে চাচ্ছি না।’
এদিকে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা কাটছে, জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, মোটরসাইকেলের ব্যাপারে শিগগিরই কোনো সুখবর আসছে না। কারণ এ বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। এ ছাড়া এ বিষয়ে সরকারের এবং মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসার ব্যাপার রয়েছে।
গত ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহরের ১৮টি গাড়ির ১৬ হাজার ৪০০ টাকার টোল দেন তিনি। পদ্মা সেতুর প্রথম টোল আদায় এটি। এর পর কেটে গেছে আরও ৭টি দিন। এর মধ্যে শনিবার কত টোল আদায় হয়েছে তার হিসাব এখনও পায়নি সেতু কর্তৃপক্ষ। কারণ আগের দিন রাত ১২টা থেকে পরের দিন রাত ১২টার মোট ২৪ ঘণ্টার হিসাব প্রকাশ করে প্রতিদিন। সে হিসাবে শনিবারের টোলের হিসাব পাওয়া যাবে আজ সকালে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দিন টোল আদায় হয়েছিল ২ কোটি
৪০ হাজার ৩০০ টাকা। সেদিন সেতু দিয়ে ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন চলাচল করে। দ্বিতীয় দিন ১ কোটি ৯৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮২০ টাকা টোল আদায় করা হয়। এদিন ১৫ হাজার ৪২৯টি যানবাহন চলাচল করে। তৃতীয় দিন ১ কোটি ৯৪ লাখ ৫৮ হাজার ১০০ টাকা টোল আদায় হয়, আর যানবাহন চলাচল করে ১৪ হাজার ৪৯৩টি। চতুর্থ দিন ১ কোটি ৯২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা টোল আদায় হয়। এদিন চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ১০৫টি। পরের দিন ৩০ জুন টোল আদায় হয় ১ কোটি ৯৭ লাখ ৯২ হাজার ৪৫০ টাকা। গাড়ি পারাপার হয় ১৪ হাজার ৪১০টি। সর্বশেষ গত ১ জুলাই টোল আদায় হয়েছে রেকর্ড ৩ কোটি ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ২০০ টাকা। যানবাহন পারাপার হয় ২৬ হাজার ৩৯৮টি। জাজিরা প্রান্তে আদায় হয়েছে ১ কোটি ৫১ লাখ ১১ হাজার ১০০ টাকা। যানবাহন চলাচল করেছে ১২ হাজার ৫৯৭টি। আর মাওয়া প্রান্ত দিয়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৪২ হাজার ১০০ টাকা টোল আদায় হয়েছে। এ প্রান্তে ১৩ হাজার ৮০১টি গাড়ি থেকে টোল আদায় করা হয়।
যেভাবে ৩ সেকেন্ডে আদায় হবে টোল : পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় সাতটি করে মোট ১৪টি গেট রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দুই প্রান্তে দুটি গেটে ইলেকট্রনিকস টোল কালেকশন বুথ চালু করা হলেও এগুলো এখনও কার্যকর করা হয়নি। কারণ যানবাহনে যে ডিভাইস বসানোর কথা সেগুলো বসানো হয়নি। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এর ভেতর দিয়ে একটি গাড়ি মাত্র ৩ সেকেন্ডে পার হতে পারবে। টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকা কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন বুথগুলো স্থাপন করছে। এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টোল পরিশোধের জন্য যানবাহনের উইন্ডশিল্ডে লাগাতে হবে বিশেষ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) কার্ড। ফাস্ট ট্র্যাকের মাধ্যমে এই প্রি-পেইড কার্ড থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল কেটে নেবে ইটিসি বুথ।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (কারিগরি) কাজী মোহাম্মাদ ফেরদৌস বলেন, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় সাতটি করে মোট ১৪টি গেট রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দুই প্রান্তে দুটি গেটে ইলেকট্রনিকস টোল কালেকশন বুথ চালু হবে। যার ভেতর দিয়ে একটি গাড়ি মাত্র তিন সেকেন্ডে পার হতে পারবে। বাকি ১২টি গেট ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। তবে যানবাহনে আরএফআইডি কার্ডের ব্যবহার যত বাড়বে তত ইটিসি বুথ বাড়ানো হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল সুবিধা চালুর চিন্তা রয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল পেমেন্টের জন্য যানবাহনে অবশ্যই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অনুমোদিত আরএফআইডি ট্যাগ থাকতে হবে। গাড়ির মালিক ব্যাংকে বা টোল প্লাজায় গিয়ে আরএফআইডির জন্য সরাসরি নিবন্ধন করতে পারবেন। এই নিবন্ধনের জন্য যানবাহন মালিকদের অবশ্যই ডাচ্-বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা রকেট মোবাইল অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। রকেট অ্যাকাউন্টটি নেক্সাস-পে অ্যাপ্লিকেশনটিতে আগে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের পর তারা ইলেকট্রনিক টোল দেওয়ার সুবিধা পাবেন।
এ বিষয়ে সেতু সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘সেতু এলাকায় একটি অটোমেটিক টোল সিস্টেম থাকবে। এর জন্য আমাদের কিছুটা সময় লাগবে। যে কোম্পানি কাজ নিয়েছে তাদের অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে ইটিসি চালু করতে। সেই সিস্টেমটা থাকবে এমন যে, কারও কাছে নির্দিষ্ট কার্ড থাকলে তার গাড়ি আনইন্টারাপ্টেড ক্রস করবে। গাড়ি থামাতে হবে না। কার্ড থেকে টাকা কেটে নেওয়া হবে, যেটা ইটিসি (ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন) বলে। টাকা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে চলে যাবে, বার উঠে যাবে।
জানা যায়, কারও কাছে কার্ড না থাকলে সে ক্যাশ দিয়ে অথবা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করেও পার হতে পারবে। প্রতিটি সিস্টেমে একটা ডেডিকেটেড ইটিসি প্রথমে থাকবে, আস্তে আস্তে আমরা পুরোটাই ইটিসিতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করব।
উল্লেখ্য, কোরিয়া ও চীনের দুটি কোম্পানি যৌথভাবে পাঁচ বছরের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে। এরা হলো কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। কোম্পানি দুটি এ জন্য পাবে ৬৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।