মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী।। ফিরে এলো মাহে রমজান। আজ থেকে মাবুদের অফুরান রহমতের বারিধারায় সিক্ত হবে রোজাদারের রুহ। বরকতের জোয়ার লেগে ফুলফল ফুটতে থাকবে মনের জমিনে। নাজাতের সওগাত বিতরণ হবে সারা জাহানে।
রমজান আসে নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়ন, সামাজিক শিষ্টাচার, পারস্পরিক সহনশীলতা, সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। তাকওয়া-খোদাভীতি, ধৈর্য, ত্যাগ, সাধনা, দয়াদ্রতা, দানশীলতা ও মানবপ্রেমের মতো নৈতিক গুণাবলির বিকাশ হয় এ মাসে। একমাত্র নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণেই মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতেই প্রতি বছর আসে মাহে রমজান।
মানুষ যখন নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলে তখন হয়ে যায় ইতর পশুর মতো; বরং তার চেয়েও অধম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি তো বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তাতে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু আছে, তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে, তা দিয়ে শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হলো গাফেল (সূরা আরাফ : ১৭৯)।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। এ সময় ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা ভোগ করে রোজাদার আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকে; প্রাণপ্রিয় স্ত্রী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এভাবে কাম, ক্রোধ, লোভ ও নানা রকম দোষণীয় স্বভাব যেগুলো মানুষকে নিয়ে যায় পশুর স্তরে, যেগুলো জন্ম দেয় সমাজে নানা অশান্তি ও অনাচার-এর সঙ্গে রোজাদারের সংগ্রাম চলে মাসব্যাপী। এক মাসের এ কৃচ্ছ সাধন ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের নির্দেশ মতো। এভাবেই মানবদেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকের শাসন ও আল্লাহর রাজত্ব। সারা দিন উপবাসে কাতর হয়ে রোজাদার যখন ইফতারের সময় খাবার সামনে নিয়ে বসে তা একাকী নিজে খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে না। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র বাণী বেজে ওঠে তার হৃদয় তারে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ব্যক্তির গোনাহের ক্ষমা ও দোজখ থেকে মুক্তি লাভের সম্বল হবে এবং তাকে ওই রোজাদারের রোজার সমতুল্য অতিরিক্ত সওয়াব দেওয়া হবে’ (বায়হাকির বরাতে মিশকাত)। যারা সমাজের উপরতলার বাসিন্দা তারাও রমজানে উপোস থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন অনাহার-উপবাসের কী যন্ত্রণা। তাই তারা নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ জাকাত হিসাবে বিতরণ করেন গরিবদের মাঝে। রমজান শেষ হতেই তারা ফিতরা দিয়ে দেন অভাবী লোকদের হাতে। আর সে জাকাত-ফিতরায় গরিবদের সংসারে ফিরে আসে সচ্ছলতা। ধনীর ধনের প্রতি হিংসা আক্রোশের পরিবর্তে গরিবদের মনে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভাবধারা। আল্লাহর জন্য দান করে ধনীরাও পায় অনাবিল তৃপ্তি ও কল্যাণ। এমনি করে মাহে রমজানে ধনী ও গরিবের মাঝে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন হয়।
ইফতারের পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবি নামাজের। যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। তারাবির পর বিশ্রামের জন্য যেতে না যেতে আবার শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার ডাক পড়ে। রমজানে কর্মব্যস্ততা আর তৎপরতা মানুষের যাবতীয় অলসতা-বিলাসিতা দূর করে তাকে সতেজ করে দেয়। এ মাস নিত্য-নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও কর্ম ব্যস্ততায় উজ্জীবিত করে রোজাদারকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু নিয়মশৃঙ্খলা ও গতিশীলতা।
রমজান হচ্ছে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন সামাজিক উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মাসব্যাপী এক কর্মশালা। এ কর্মশালা রোজাদারের মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে আল্লাহর অফুরান প্রতিদান লাভের ইচ্ছা। এজন্য রোজার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পানাহার ও স্ত্রী সংশ্রব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত ও সওয়াবের নিয়ত করা। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবিজি (সা.) বলেন, ‘আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’ (বুখারি শরিফ)। বিশুদ্ধ নিয়তের রোজা মুমিন বান্দার অন্তরে এনে দেয় দুর্জয় শক্তি। যে শক্তি বান্দাকে আল্লাহর দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্বের যথার্থ উপলব্ধি দিয়ে পাশাপাশি বানিয়ে দেয় ইনসানে কামিল। নবিজি (সা.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমান ও এহতেসাবসহকারে (আত্মবিশ্লেষণ) রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’ (বুখারি শরিফ)। এমনিভাবে রোজা সম্বন্ধে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ পাক বলেন, ‘রোজা একমাত্র আমার জন্য এবং তার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেব, অথবা অন্য অর্থে আমিই স্বয়ং তার প্রতিদান’ (বুখারি, মুসলিমের বরাতে, মিশকাত)। দুনিয়ার সব অশান্তির মূল আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা। রমজান মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয়, আত্ম উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি। ফলে কোনো বিশেষ ফোর্স বা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না রোজাদারকে শাসন করার জন্য। রোজাদার আল্লাহর ভয়ে নিজে নিজেই সংযত হয়ে যায়। আদর্শ নাগরিক, সোনার মানুষ, আল্লাহর প্রতিনিধি, দ্বীনের মুজাহিদ প্রভৃতি যেকোনো উপাধিই প্রযোজ্য হয় রোজাদারের জন্য। আল্লাহ আমাদের মাসব্যাপী সাধনার একনিষ্ঠ সাধক বানিয়ে দিন।